মতামত

শিল্পায়ন এগিয়ে যাক স্বাস্থ্য সরঞ্জাম তৈরি করে

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান : বাণিজ্যনীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুটি জনপ্রিয় তত্ত্ব আছে, ‘আমদানি বিকল্প উৎপাদনের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি’ যা পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয় হয়, যার ভিত্তি ছিল ‘সিঙ্গার-প্রেবিশ’ তত্ত্ব। ‘আশির দশকে তা বাতিল হয়ে ‘রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধি’–এর স্থান দখল করে। ‘যার প্রায়োগিক ভিত্তি ছিল, পূর্ব এশিয়ার চার ব্যাঘ্র অর্থনীতি হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উত্থান। এ নীতির প্রধান প্রবক্তা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহ। তারা সংস্কার কর্মসূচির শর্ত হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর তা নব্বইয়ের দশক থেকে চাপিয়ে দেয়।

প্রথম থেকেই রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধির কৌশল সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। এমনকি আঙ্কটাডের একটি গবেষণায় বিভিন্ন দেশের ও সময়ের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক তেমন জোরালো নয়। এবং এটা ‘প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি’ নয়। কেননা, প্রবৃদ্ধির ওপর রপ্তানির প্রভাব সীমিত-স্বল্প এমনকি দীর্ঘ মেয়াদেও। তাই এটাকে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন কৌশল হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়; কেননা, এ কৌশল সীমিতসংখ্যক দেশের ক্ষেত্রে সীমিতভাবে প্রযোজ্য।

করোনা–পরবর্তী বিশ্বে ‘রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধি’ আরও বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। দেখা গেল যে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ও আগাম মূল্য পরিশোধ সত্ত্বেও ভারত টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কেবল ভারতই নয়, অনেক উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং স্বদেশে টিকার বিরাট মজুত গড়ে তোলে, ফলে অন্যান্য দেশ বঞ্চিত হয়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইন অনুযায়ী আপৎকালে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ অবৈধ নয়।

তাই এখন ভাবা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের ‘রপ্তানি’ ও ‘আমদানি বিকল্প উৎপাদন’—এ দুই পায়ে হাঁটতে হবে। বিশেষত, জনগণের জীবন বাঁচানোর তাগিদে। চীনের বিপরীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দৌড়ে ভারতের পরাস্ত হওয়ার এটাও একটা কারণ। ভারতে সেবা খাতের প্রসার ঘটলেও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে তেমন একটা প্রবৃদ্ধি ঘটেনি।

স্বাস্থ্যসামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রে রপ্তানি ও আমদানি বিকল্প উৎপাদন দুটি বিষয় সাংঘর্ষিক নয়। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের বিপুল দেশীয় বাজার মাথায় রেখে উৎপাদন বাড়ালে ক্রমে তা অধিক উৎপাদনজনিত মূল্যহ্রাসের ফলে রপ্তানি পণ্য হয়ে উঠবে।

‘রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধি’ কৌশলের সীমাবদ্ধতা

তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও সামগ্রিক কৌশল হিসেবে বাংলাদেশে ‘রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা’ সীমিত। কেননা, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা সীমিত। বিগত বছরসমূহে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলসহ অন্যান্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওষুধ ছাড়া নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য পণ্য এ তালিকায় সংযুক্ত করা যায়নি। প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের ১০টি প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা মাত্র দুটি—নিট ও বোনা তৈরি পোশাক; ১ বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা একটি—বিভিন্ন টেক্সটাইল ও পরনের কাপড়। অর্ধবিলিয়নের বেশি কিন্তু এক বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য তিনটি—পাদুকা, সুতা ও বোনা কাপড় ও মাছ; ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি কিন্তু অর্ধবিলিয়ন ডলারের কম চারটি পণ্য রয়েছে—চামড়া, হেডগিয়ার, প্রাণিজ ও সবজিজাত চর্বি এবং কৃত্রিম ফুল।

অন্যদিকে ভিয়েতনামের প্রধান ১০টি রপ্তানি পণ্যের প্রতিটিই প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। সবার শীর্ষে আছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ১৫৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কম্পিউটার ও অন্যান্য মেশিনারি ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তৈরি পোশাক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, পাদুকা ২৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ফার্নিচার, বেডিং, লাইটিং সাইনস, প্রিফ্যাব বিল্ডিং ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অপটিক্যাল, টেকনিক্যাল ও মেডিকেল সরঞ্জাম ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকসামগ্রী ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাছ ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রাবার ও রাবারজাত সামগ্রী ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। লক্ষণীয়, ভিয়েতনামের প্রধান রপ্তানি পণ্যসমূহ ম্যানুফ্যাকচারিং ও প্রযুক্তিনির্ভর। তাই রপ্তানি পণ্যের তালিকার গভীরতা ও মূল্য বিবেচনায় ‘রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধি’ কৌশল ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাংলাদেশে এর ভূমিকা সীমিত।

রপ্তানিচালিত প্রবৃদ্ধি কৌশল এবং শুধু দুটি প্রধান রপ্তানি পণ্য থাকার আরেকটি কুফল হলো, এগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংগঠন অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এরা বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি, মুদ্রানীতি, এমনকি স্বাস্থ্য খাতের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিকৃতি ঘটাচ্ছে।

স্বাস্থ্য সরঞ্জামের বৈশ্বিক বাজার

প্রেসেডেন্স রিসার্চ–এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৭ সাল নাগাদ স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদির বৈশ্বিক বাজার ৬৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। এর সঙ্গে ২০২৪ সাল নাগাদ টিকার ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাজার যোগ করলে তা দাঁড়াবে ৭৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সরঞ্জামের বাজার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সরঞ্জামের বাজার আমদানিনির্ভর। স্থানীয় উৎপাদকেরা চাহিদার কেবল ১৫ শতাংশ উৎপাদন করে থাকেন। বাকি ৮৫ শতাংশ আমদানি হয় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদির বাজার শূন্য দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো, যা প্রতিবছর ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ হিসাবে টিকার বাজারকে ধরা হয়নি। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের আমদানির মধ্যে রয়েছে ঘরে ঘরে ব্যবহৃত থার্মোমিটার থেকে শুরু করে হালে অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠা অক্সিমিটার, অক্সিজেন, সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর ও এক্স-রে মেশিন, অন্যান্য আধুনিক সব যন্ত্রপাতির প্রায় সবই আমদানি করা হয়।

তাই দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদন করে কেবল বাংলাদেশ স্থানীয় চাহিদার অধিকাংশ মেটানো ছাড়াও বিদেশে রপ্তানির বিশাল সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, রপ্তানি বাণিজ্যে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অপটিক্যাল, টেকনিক্যাল ও মেডিকেল সরঞ্জাম রপ্তানি করে থাকে।

কোথা থেকে শুরু করা যায়

হ্যাঁ, শুরু করতে হবে টিকা উৎপাদন দিয়ে এবং তা সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে নিয়েই। টিকা আমদানি নিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এক দেশনির্ভরতা আমাদের যথেষ্ট ভুগিয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথকে সক্রিয় করা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির টিকা প্রস্তুত বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে বলে শুনেছি। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে আর্থিক, প্রযুক্তিসক্ষমতা ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সপ্রাপ্তির ভিত্তিতে, দলীয় পরিচিতিতে নয়। টিকার পর দেশে বিপুল চাহিদা আছে এমন সব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদন এবং পরে উচ্চ প্রযুক্তি ও মূল্যের এসব পণ্য উৎপাদন করতে হবে।

কীভাবে শুরু করতে হবে

প্রথমেই স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতাকে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ম্যানুফ্যাকচারিংকে উৎসাহিত করতে হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (বিদেশে স্টেম নামে পরিচিত) শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে; পাশাপাশি ভোকেশনাল শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

সর্বোপরি, সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হবে। আমাদের দেশে বেসরকারি লগ্নি পুঁজির অধিকাংশ কেনাবেচায় (ট্রেডিং) এটি ব্যবহৃত হয়। সেখানে বিনিয়োগ অপেক্ষা স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদনকে লাভজনক করতে হবে। এ জন্য এ খাতকে গার্মেন্টস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের মতো প্রণোদনা দিতে হবে। গার্মেন্টস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে প্রণোদনা ক্রমান্বয়ে কমাতে হবে। ইকোনমিক জোনগুলোতে এসব শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদনকে সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত করতে হবে।

আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন। কেননা, এর সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত।

লেখক : মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ।

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সংহতি জানালো মুক্তিজোট

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সোমবার (৭ এপ্রিল) বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জ...

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ্মীপুরে হরতাল অবরোধ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ...

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলনে কৃষকরা খুশি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। এসব মিষ্টি কুমড়া যাচ্ছে দেশে...

টিভিতে আজকের খেলা

প্রতিদিনের মতো আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) বেশ কিছু খেলা প্রচারিত হবে টেলিভিশনের পর্...

গাজায় হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও উত্তাল

গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানির প্রতিবাদে বৈশ্বিক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে যুক্...

ইসরায়েল নিশ্চিহ্নে হামাস ইরানের কাছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল!

ইরান ও হামাস নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ইসরায়েলে...

ঈদে কে কোন আসনে সক্রিয় ছিলেন এনসিপি নেতারা

পবিত্র ঈদুল ফিতরে অন্তত ৪০টি নির্বাচনী আসনে জনসংযো...

খুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত&rsquo...

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ্মীপুরে হরতাল অবরোধ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ...

গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টা; ওসি-এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সুনির্দিষ্ট কোন মামলা ছাড়াই এক গৃহবধূকে (২৫) আটক করে ধর্ষণচেষ্টা ও চাঁদাবাজির...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা