খন্দকার এম এস কাউসার : দীর্ঘ ২১ বছর পর মেসি এবং বার্সেলোনার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবে এ বিচ্ছেদ পরিস্থিতির কারণে, ‘বর-কনের’ ইচ্ছায় নয়। বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮টি ম্যাচ খেলে ৬৭২টি গোল দেওয়া এবং ছয়বারের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী মেসি এবং তাঁর দল বার্সেলোনার চুক্তি শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন।
এ বিচ্ছেদ যেন বিল ও মেলিন্ডা গেটসের মতো হাসতে হাসতে বিচ্ছেদ। ২১ বছরের প্রেমময় সংসারের মতৈক্যের বিচ্ছেদ। মতৈক্যের পেছনে কত মতানৈক্য ছিল, কবে কে তা জানতে পারবে? কে কাকে কেন ছাড়ছে, কে বা তা জানে? এ যেন হেলাল হাফিজের ভাষায়, ‘থাক না ধ্রুপদি অস্পষ্টতা, কে কাকে গেলাম ছেড়ে।’ আমরা ফুটবল বোদ্ধারা চাই বার্সা জীবনানন্দের মতো বলুক, ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা।’ আমরা চাই মেসিকে ফিরিয়ে আনুক বার্সা। বাস্তবতার বিবেচনায় এমন দাবি আবেগপূর্ণই বলা যায়।
আপাতদৃষ্টে এ ছেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে সূত্র। স্পেনের সরকার ফুটবলের জন্য একটি ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে সূত্র তৈরি করেছিল ২০১৩ সালে, যেখানে ফুটবল ক্লাবগুলোর সুষম অর্থনৈতিক বিন্যাস এবং খরচের স্বচ্ছ পরিকল্পনা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সূত্রের উদ্দেশ্য ছিল সব দল সমান লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাবে এবং কোনো দল অপরিকল্পিত খরচের সুবিধা নিতে পারবে না। তথ্যমতে, লা লিগার ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে সূত্র মানতে গিয়ে বার্সেলোনাকে তার খরচের খাতা, বিশেষত খেলোয়াড়দের বেতন কমাতে হয়েছে। মেসির বেতন ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তেও বার্সেলোনা এ তরী পার হতে পারল না। ফলাফল, যেতে নাহি দিব তবু যেতে দিতে হয়। উল্লেখ্য, কোভিড-১৯-এর কারণে বার্সাকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য তাদের বাজেট উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে হয়েছে।
এই ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে বা অর্থনীতির যৌক্তিক বিন্যাস সূত্রই বাংলাদেশকে নিয়ে আমার বর্তমান আলোচনার পুষ্টির জোগানদাতা। আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সুষম বিন্যাস থাকতে হবে এবং সব ক্ষেত্রে খরচের স্বচ্ছ পরিকল্পনা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। বাজেট আমাদের আদর্শের বহিঃপ্রকাশ, জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা বোঝা যায় বাজেট থেকে। এ বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় টাকাকে এলোমেলো বিচরণ থেকে রক্ষা করা এবং আয়-ব্যয়ের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। বার্সায় মেসিকে না নিতে পারা আমাদের আরেকবার শেখাল, বাজেট তৈরি করা মানে একটি প্রাচীন এবং শক্তিশালী শব্দকে আত্মস্থ করা, তা হলো—‘না’। অপরিকল্পিত খরচকে ‘না’ বলার নামই বাজেট।
বাংলাদেশের গত বাজেট অনেক ভালো ছিল। বাস্তবায়নও যাতে অনুরূপ ভালো হয়। কালের পরিক্রমায় সে বাস্তবায়নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একটা প্রচলিত গল্প বলি। ইতালির সরকার একটা সফটওয়্যার বানানোর জন্য কোটেশন চাইল। তিন দেশের তিন প্রতিষ্ঠান কোটেশন দিল। চীন, জার্মানি ও রাশিয়া। চীন কোটেশন দিল এক মিলিয়ন ডলার, জার্মানি দিল দুই মিলিয়ন ডলার। জার্মানিকে জিজ্ঞেস করা হলো, চীন এবং তোমাদের মধ্যে কোটেশনের এত পার্থক্য কেন? জার্মানি বলল, আমরা ভালো কোয়ালিটির কাজ করি, চীনের মতো এত সস্তা মানের কাজ করি না।
এদিকে রাশিয়া কোটেশন দিল তিন মিলিয়ন ডলার। রাশিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনারা এত বেশি কোটেশন দিলেন কেন? রাশিয়া উত্তর দিল, এক মিলিয়ন আপনার জন্য, এক মিলিয়ন আমার জন্য আর শেষ এক মিলিয়ন চীনকে দিয়ে কাজ করার জন্য। বাংলাদেশে এমন রাশিয়ানরা যাতে কাজ না পায়। পুকুর খননের টাকা নিয়ে পুকুর না খনন করে বরং খনন করে পুনরায় ভরাট করা হয়েছে বলে দুবার বরাদ্দ যাতে না নিতে পারে দুর্বৃত্তরা। দেশকে মধ্যম আয়ে উন্নীত করার মতো অর্জন যেন গুটি কয়েক দুর্নীতিবাজের কারণে ফ্যাকাশে না হয়ে যায়। সাদা কাপড়ে সামান্য কালো দাগ কিন্তু স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যাংক এবং তার স্টেকহোল্ডাররা যাতে প্রকৃতপক্ষে ট্রাস্টি হয়, বেনিফিশিয়ারি যাতে না হয়। কথিত আছে, আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন আপনার টাকার প্রয়োজন নেই, দেখবেন ব্যাংকগুলো আপনাকে ঋণ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। শেয়ারবাজার আরও স্বচ্ছতায় আনতে হবে। স্বচ্ছতা আসবেই, কারণ শেয়ারবাজারে সবাই খুব স্মার্ট। শেয়ারবাজারে প্রতিবার যখন কেউ বিক্রি করে, অন্য কেউ তা কিনে নেয় এবং উভয়ে নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করে।
দেশ চালানোর জন্য সরকারকে জনগণের ওপর করারোপ করতেই হবে, তাই বলে তা যেন কর বোঝা না হয়। এক কামড়ে সন্তানের আইসক্রিমের ৩০ শতাংশ খেয়ে তাকে ট্যাক্স কী, তা বোঝাবেন না। ট্যাক্সের রিসিট মাড়িয়েই সভ্যতা গড়ে ওঠে এটা আমরা জানি, জনগণকে মাড়িয়ে নয়। তাই সরকারকে ট্যাক্স সংগ্রহ বাড়াতে হবে তার পরিধি বাড়িয়ে। একদিকে যেমন করারোপ ন্যায়ভিত্তিক হতে হবে, অন্যদিকে কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে এবং স্বচ্ছতা আনতেই হবে।
লেখক : খন্দকার এম এস কাউসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
সান নিউজ/এনএম