মফিদুল হক : রামেন্দু মজুমদারের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে আকাশ ও মাটির কাহিনি বলতে গেলে না খুঁজে পাওয়া যাবে এর তল, না এর সীমানা। তবে মানুষটির সঙ্গে পথ চলছি দীর্ঘকাল। চলার পথে সঞ্চয় আহরণ করেছি অনেক। কেবল আমি নই, আরও কত মানুষ। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁর কল্যাণধারায় সিক্ত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে কিছু কথা যদি বলতে হয়, তবে সংক্ষেপে হলেও দুরূহ সেই চেষ্টা আমাদের নিতে হবে।
স্পেনের কবি হিমেনেথ সংক্ষেপেই বলেছেন সে কথা, ‘শিকড়ের হোক ডানা, ডানার শিকড়।’ রামেন্দু মজুমদারের জীবন-পরিক্রমণ যখন দেখি, তখন এ কথাই আমার মনে হয়, শিকড় তিনি জারিত করেছেন মাটির গভীরে, শিকড়বিচ্ছিন্ন তিনি হতে চাননি আর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে এনে দিয়েছে বিস্তার, স্বদেশে ও বিশ্বে।
লক্ষ্মীপুরের যে বর্ধিঞ্চু গ্রামের সম্পন্ন পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, উপমহাদেশের রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক ঘাতকেরা সেখানেও হানা দিয়েছিল, আক্রান্ত হয়েছিল তাঁদের বাড়ি, নৌকায় করে সন্ত্রস্ত পরিবারকে পালিয়ে যেতে হয়েছে নোয়াখালী শহরে। একই সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবতার উত্থানও তো লক্ষণীয়, পরিবারের সদস্যদের জীবন রক্ষা ও বাড়িঘরের হেফাজতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল মুসলিম প্রতিবেশী, ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দাঙ্গাবাজদের। এরপর নোয়াখালী এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, তিন মাসের বেশি সময়জুড়ে একাদিক্রমে ঘুরেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে, ফিরিয়ে এনেছিলেন সম্প্রীতির আবহ। রামেন্দু মজুমদারের পরিবারও ফিরে এসেছিল তাদের আবাসে।
তবে আমরা জানি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত হতে পারেনি বাংলা; বরং সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বেরই বিজয় ঘটেছিল, প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান, যে পাকিস্তানে রামেন্দু মজুমদারের বেড়ে ওঠা। ষাটের দশকে ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তাঁর ঢাকায় আগমন, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্তি; মুনীর চৌধুরী, আশকার ইবনে শাইখ, নুরুল মোমেনের সান্নিধ্য; নাট্য সতীর্থ হিসেবে আবদুল্লাহ আল-মামুন, নাজমুল হুদা, ফেরদৌসী মজুমদার ও আরও নবীন প্রতিভার সাহচর্য লাভ। সবাই মিলে পাকিস্তানি মতাদর্শের অস্বীকৃতিমূলক সংস্কৃতিধারা যেভাবে বলবান হয়, তা বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের ইতিহাসের অনন্য এক অধ্যায়।
একই সময়ে সাম্প্রদায়িক দংশন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় রামেন্দু মজুমদার মা-বোনদের নিয়ে আটকা পড়েন তেজগাঁও রেল বস্তিসংলগ্ন ভাইয়ের পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষক আবাসে। এক সকালে সেখানে জিপ নিয়ে হাজির হন শেখ মুজিবুর রহমান, উপদ্রুত এলাকায় আটক হিন্দু পরিবারগুলোকে উদ্ধারে তাঁর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অংশ হিসেবে। সপরিবার রামেন্দু মজুমদার আশ্রয় পান ৩২ নম্বরের বাড়িতে, সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যান মুনীর চৌধুরী। এরপর ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং এর ফলে বিত্তবান হিন্দু পরিবারদের উৎখাতে যে আয়োজন শুরু হয়, তা থেকে রক্ষা পেতে রামেন্দু মজুমদারের পিতা লক্ষ্মীপুরের নবনির্মিত বাড়ি প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারকে প্রায় সমর্পণ করে সপরিবার দেশত্যাগ করেন।
কেবল রয়ে যান রামেন্দু মজুমদার। এরপর ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে প্রেম-পরিণয় এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে উভয়ের সম্পৃক্তি, সে আরেক ইতিহাস। এখানে কেবল এটুকু উল্লেখ করতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সংকলন তৈরি করে এর ইংরেজি অনুবাদ দিল্লি থেকে প্রকাশ করেন রামেন্দু মজুমদার ‘বাংলাদেশ, মাই বাংলাদেশ’ নামে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রামেন্দু মজুমদারও যে ঝাঁপ দেবেন সাংস্কৃতিক বিকাশ ও জাগরণের কর্মকাণ্ডে, সেটা বুঝতে পারা যায় সহজেই। তবে কী ছিল সেসব কাজের মাত্রা, সেই পরিচয়দান দুঃসাধ্য। তিনি ও তাঁর সাথিরা মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন নাট্যদল ‘থিয়েটার’, সামান্য সামর্থ্য অর্জনের পর রামেন্দু মজুমদার প্রকাশ শুরু করলেন ত্রৈমাসিক নাট্যপত্র ‘থিয়েটার’, যা আজও অব্যাহতভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। নাট্যজগতে আরও যেসব দল ও ব্যক্তি সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক তৈরিতে রামেন্দু মজুমদারের ছিল অগ্রজের ভূমিকা।
১৯৮১ সালে তিনি, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আতাউর রহমান প্রমুখ মিলে জন্ম দিলেন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। একই ধারার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে এমন সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলায় ফেডারেশন ছিল পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। এমন সাংস্কৃতিক সৌভ্রাতৃত্বের প্রকাশ আরও নানাভাবে প্রলম্বিত হতে আমরা দেখি, যা রূপায়িত হয়েছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে, যেখানে ফয়েজ আহমদের দক্ষিণ হাত ছিলেন রামেন্দু মজুমদার।
রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নাট্যাঙ্গনের পরিচিতি ঘটে কোরিয়ায় এক নাট্যোৎসবে যোগদানের সুবাদে, সেখানে অনেক নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আমেরিকার ব্ল্যাক থিয়েটারের ধাত্রী হিসেবে খ্যাতিমান নিউইয়র্কের ‘লা মামা’ থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা এলেন স্টুয়ার্টের নজর তিনি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেন। এলেন স্টুয়ার্টই রামেন্দু মজুমদারকে ইউনেসকোর সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। সেই সুবাদে হেলসিংকিতে আয়োজিত কংগ্রেসে যোগ দিলেন রামেন্দু মজুমদার ও আতাউর রহমান। রামেন্দু মজুমদার বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে আন্তর্জাতিক নাট্যচর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন, আরও অনেক নাট্যশিল্পী ও কর্মীকে যুক্ত করেন আইটিআইয়ের সঙ্গে; দেশের বাইরের উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা এবং বিদেশি নাট্যব্যক্তিত্ব ও দল অংশ নেয় বাংলাদেশের উৎসবে, সেমিনারে, কর্মশালায়।
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নাট্যাঙ্গনে বিশেষ স্থান করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন ছাড়াই অসাধারণ অর্জন বাস্তব করেছেন রামেন্দু মজুমদার। সেই সঙ্গে তিনি নিজেকে যেভাবে সম্মানীয় করে তুলেছেন, এর বড় সাক্ষী আমি। আইটিআইয়ের কমিউনিকেশন কমিটির সদস্য থেকে পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। অর্থের অভাবে আইটিআইয়ের দ্বিবার্ষিক সংকলন ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার’ প্রকাশনা যখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো, তখন বাংলাদেশ থেকে এর দায়ভার গ্রহণ করলেন রামেন্দু মজুমদার। এরপর বিগত ২৫ বছরের বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশ প্রকাশ করছে বিশ্বনাট্যের এই অনন্য সংকলন।
একের পর এক সাফল্যের সোপান পেরিয়ে রামেন্দু মজুমদার বিপুল সমর্থনে নির্বাচিত হলেন আইটিআইয়ের বিশ্ব সভাপতি। এ যে কত বড় অর্জন, তা বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না! দুই মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর তিনি এখন সংস্থার সাম্মানিক সভাপতি। এমন সম্মান অর্জনের পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশে তাঁর সম্পৃক্তি রয়েছে সজাগ ও সক্রিয়। একই সঙ্গে কয়েক বছর আগে তাঁর গ্রামের পৈতৃক গৃহ ও ভূসম্পত্তি তিনি অর্পণ করেছেন সংলগ্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর শিকড় এভাবে জারিত হয়েছে মাটির আরও গভীরে এবং দুহাত মেলা আছে উচ্চ আকাশে। জয় হোক এই মানুষটির।
লেখক : মফিদুল হক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি
সান নিউজ/এনএম