মতামত

পরীমনিদের মানসম্মান

আসিফ নজরুল : আমি সাংবিধানিক আইন পড়াই ছাত্রদের। এটা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে বিপাকে পড়তে হয়। আমি আইন বুঝিয়ে বলি, ছাত্ররা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। যেমন: আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে, আইন মোতাবেক ছাড়া কারও জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পদ, সুনাম এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এটা যে কিছুতেই করা যাবে না, তা বোঝাতে সংবিধানের এই একটিমাত্র অনুচ্ছেদে কথাটা পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে।

শুধু সংবিধান বললে অনেক কিছু বোঝা যায় না। ছাত্রদের তাই উদাহরণ দিয়ে বলি, বাংলাদেশের কোনো আইনে কাউকে গুম বা ক্রসফায়ার করা যাবে, বলা নেই। তাই এটা করাটা সংবিধানের লঙ্ঘন। আবার কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর বুকে ‘ধর্ষক’ বা ‘মাদক ব্যবসায়ী’ লেখা কাগজ সাঁটিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর সুনামহানি ঘটায়। কোনো আইনে এভাবে সুনামহানি করাকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তাই এটিও সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদবিরোধী। ছাত্ররা অবাক হয়। কারণ, এসব তো তারা হরহামেশা দেখতে অভ্যস্ত। তারা প্রশ্ন করে, তাহলে এগুলো হয় কীভাবে? এ নিয়ে বেশি আলোচনার অবকাশ থাকে না। শেষে না পেরে বলি, ‘আমি তোমাদের আইন পড়াই। লঙ্ঘন যেটা হচ্ছে, সেটা আইনের শাসনের পরিপন্থী।’

সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ আমরা বেশি লঙ্ঘিত হতে দেখি কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পরের ঘটনায়। বিনা আইনে, বিনা বিচারে গ্রেপ্তার ব্যক্তি সম্পর্কে সম্মানহানিকর সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার করা শুরু করি আমরা অনেকে। বিনা আইনে গুম বা ক্রসফায়ার করা হয় লুকিয়ে বা মিথ্যা কোনো গল্প বলে। কিন্তু বিনা আইনে সম্মানহানি করা হয় সদর্প, টেলিভিশন আর পত্রিকার সামনে। এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে কোনো নারী গ্রেপ্তার হলে। আগে শামীমা নূর পাপিয়া বা ডা. সাবরিনা আরিফের গ্রেপ্তারের পর মূল অভিযোগের পাশাপাশি তাঁদের চরিত্র নিয়ে নানা নোংরা কাহিনি ছাপা হয়েছে কিছু গণমাধ্যমে, বিশেষ করে অনলাইনসর্বস্ব পত্রিকায়। এখন ছাপা হচ্ছে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হেলেনা জাহাঙ্গীর, ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ সম্পর্কে। মাত্র গত বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। আমি নিশ্চিত, তাঁর সম্পর্কেও একতরফা মুখরোচক সংবাদ পরিবেশনের হিড়িক শুরু হবে অচিরেই, ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। মনে হয় না, এ জন্য কাউকে কোনো জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে এ দেশে। মনে হয় না, এর অনৈতিক দিকটি সম্পর্কে ভাবেন আমাদের অনেকেই।

বিনা আইনে, বিনা বিচারে গ্রেপ্তার ব্যক্তি সম্পর্কে সম্মানহানিকর সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার করা শুরু করি আমরা অনেকে। বিনা আইনে গুম বা ক্রসফায়ার করা হয় লুকিয়ে বা মিথ্যা কোনো গল্প বলে। কিন্তু বিনা আইনে সম্মানহানি করা হয় সদর্প, টেলিভিশন আর পত্রিকার সামনে। এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে কোনো নারী গ্রেপ্তার হলে।

২.

সম্প্রতি গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রচারণার কিছু উদাহরণ দিই। পিয়াসা ও মৌ গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁদের আখ্যায়িত করেছেন ‘রাতের রানি’ হিসেবে। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, এরা রাতে বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তাঁদের সন্তানদের আমন্ত্রণ জানায় এবং পার্টি চলাকালে কৌশলে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করে। যত দূর মনে হয়, এমন বা এর চেয়ে মানহানিকর অভিযোগ আগেও গ্রেপ্তার হওয়া কোনো কোনো নারী সম্পর্কে করা হয়েছে। যেমন উত্তরা বোট ক্লাবের ঘটনায় অভিনেত্রী পরীমনির করা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখিত এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এটা পুলিশ করতেই পারে। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তারের সময় একই সঙ্গে তিন নারীকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের ‘রক্ষিতা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মানহানিকর বক্তব্য শুধু সংবিধান বা আইনবিরোধী নয়, বরং নৈতিকতাবিরোধীও। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এই সামান্য বোধ হারিয়ে গেছে আমাদের সমাজের অনেক স্তরে। যেমন পিয়াসা ও মৌকে পুলিশের কর্তা কর্তৃক ‘রাতের রানি’ আখ্যায়িত করাকে এক লেখক ও কলামিস্ট ‘তাঁদের অপকর্ম বোঝাতে যথার্থ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আরেক সিনিয়র সাংবাদিক তাঁর কলামে লিখেছেন, এরা ও পরীমনি চরিত্রহীনা, উঁচু দরের পতিতা এবং নারী ও মাদক ব্যবসায়ী।

আমি উদাহরণ দিলাম দেশের মূলধারার দুটো পত্রিকা থেকে। অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাহলে কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। পুলিশ ও এ ধরনের পত্রিকার অভিযোগের একটি প্রধান দিক হচ্ছে, গ্রেপ্তার নারীরা ধনী ব্যক্তি বা তাঁদের সন্তানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এমন আপত্তিকর ছবি তাঁদের সঙ্গে তোলেন যে তাঁরা মানসম্মানের ভয়ে ব্ল্যাকমেলড হতে বাধ্য হন। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এরা প্রশ্ন তোলে না সেসব ব্যক্তির পরিচয়, মানসিকতা ও অপরাধবৃত্তি নিয়ে যাঁরা ‘রাতের রানি’দের আহ্বানে স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন যে সেগুলোর ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না! এর আগে কোটি টাকা খরচ করে ওয়েস্টিনের পুরো স্যুট ভাড়া করে এমন কর্মকাণ্ড করার অভিযোগ উঠেছিল শামীমার বিরুদ্ধে। কারা কর্মকাণ্ডের পুরুষ পার্টনার ছিলেন, তা নিয়ে নয়!

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অনৈতিক কাজ বা এর ব্রিডিং গ্রাউন্ড বন্ধ করা নয়, বরং এতে ব্ল্যাকমেলের শিকার হওয়া ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্ষোভমোচনই হচ্ছে পুলিশ আর একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমের আসল কাজ! আলোচিত এসব গ্রেপ্তারের ঘটনায় আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বাসা থেকে অবধারিতভাবে মদ ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার এবং তার ব্যাপক প্রচার। প্রশ্ন আসে, এর পেছনে কি এ দেশের রক্ষণশীল সমাজমনস্তত্ত্বে প্রথমেই তাঁদের হেয় করা এবং নিজেদের সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার কোনো মানসিকতা কাজ করে? না হলে এত মাদক আর মদ তাঁরা কার কাছে বা কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, তা আমরা কখনো জানতে পারি না কেন?

৩.

গ্রেপ্তার নারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, তা অভিযোগ হিসেবেই সংবাদমাধ্যমকে জানাতে হবে। কিন্তু বিচারের আগেই তাঁদের দোষী হিসেবে উপস্থাপন বা তাঁদের সম্পর্কে অশ্লীল প্রচারণা থেকে আমাদের বের হতে হবে। তাঁরা অপরাধ করে থাকলে এর সঙ্গে জড়িত সবার (যেমন মদ বা মাদকের জোগানদাতা, পর্নোগ্রাফি বা অবাধ যৌনাচার চক্রের পৃষ্ঠপোষক, পার্টনার ও সুবিধাভোগী) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের চক্র না থাকলে কোনো নারীর পক্ষে বছরের পর বছর কথিত এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

গ্রেপ্তার নারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, তা অভিযোগ হিসেবেই সংবাদমাধ্যমকে জানাতে হবে। কিন্তু বিচারের আগেই তাঁদের দোষী হিসেবে উপস্থাপন বা তাঁদের সম্পর্কে অশ্লীল প্রচারণা থেকে আমাদের বের হতে হবে।

অপরাধ বড় হলে তার পেছনে গডফাদার থাকেন। পাপিয়া, পিয়াসা, পরীমনিদের অপরাধ বড় হলে তাঁদেরও গডফাদার থাকার কথা। এর আগে ক্যাসিনো-কাণ্ডে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার সময় আমরা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলতে শুনেছি, এমন কর্মকাণ্ডের পেছনে গডফাদার আছেন এবং তাঁরা কেউ রেহাই পাবেন না। কিন্তু পরে আমরা সম্রাটের কোনো গডফাদারকে গ্রেপ্তার হতে দেখিনি বা এমন কারও নামও শুনিনি। গডফাদারদের বাদ দিয়ে, অপরাধের সূতিকাগারে হানা না দিয়ে কিছু কথিত অপরাধী গ্রেপ্তার করে, তাঁদের নিয়ে সাতকাহন রচনা করে কেউ সস্তা বাহবা বা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারে। এর পেছনে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ’ ধরনের কোনো বিষয় থাকলে কিছু ‘উলুখাগড়ার প্রাণহরণ’ও হতে পারে। কিন্তু তাতে আসল সমস্যার সমাধান হবে না।

আসল সমস্যার সমাধান করতে হবে সংবিধান আর আইনকে সততার সঙ্গে মেনে। এসব মেনে চললে অপরাধ প্রমাণের আগে কাউকে দোষী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। অপরাধের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকেই বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধী নয়, অপরাধ দমনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীলভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে হয়, এসব কথা আমরা ভুলতে বসেছি।

লেখক : আসিফ নজরুল, আইন বিভাগের অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মিয়ানমারের দূতসহ ঢাকায় আসছেন মার্কিন ২ কর্মকর্তা

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় আসছেন মার্কিন প্রশাসন...

গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিল বাটা

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ...

টিভিতে আজকের খেলা

প্রতিদিনের মতো আজ সোমবার (৮ এপ্রিল) বেশ কিছু খেলা প্রচারিত হবে টেলিভি...

জানা গেল ২০২৫ সালের হজ ফ্লাইট শুরুর তারিখ

এবছর পবিত্র হজের প্রথম ফ্লাইট ২৯ এপ্রিল সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবে।...

নীলফামারীতে বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস অনুষ্ঠিত

‘সাহসী ও দায়িত্বশীল আগামীর প্রজন্ম’ প্...

বগুড়ায় খুন করে হাসপাতালে রেখে গেল লাশ

বগুড়ার শেরপুরে পরকীয়ার জেরে কাবিল হোসেন (৪০) নামের...

ভালুকায় মুখোশধারী নারী নেতৃত্বে সশস্ত্র ডাকাতি

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কাচিনা গ্রামে এক ভয়াবহ ড...

দেশে বিনিয়োগ সহজ করার লক্ষ্যে কাজ করেছি: প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এত অনুকূল পরিবেশ এর আগে কখনো ছিল না বলে মন্তব্য করেছ...

'বিমসটেককে গতিশীল করতে চান প্রধান উপদেষ্টা'

আগামী দুই বছরে চেয়ারম্যান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেককে একটি গতিশীল প্র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা