হাফিজউদ্দিন আহমদ : একাত্তরের ৩০ মার্চ সকাল আটটায় আমার ব্যাটালিয়ন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। পাকিস্তান বাহিনীর ২৫ বালুচ ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আমাদের ওপর তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। আট ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধের পর আমি ২০০ সৈনিক এবং ৯ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার নিয়ে শত্রুর গুলিবৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে আসি। আমাদের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হলো। তাকে যশোর-কুষ্টিয়া মহাসড়কে অবস্থিত হয়বতপুরে সৈনিকেরা দাফন করে।
আমি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বেনাপোলের দুই মাইল পূর্বে কাগজপুকুর গ্রামে, গ্র্যান্ডট্রাংক রোডকে মাঝখানে রেখে রক্ষণব্যূহ গড়ে তুলি। এপ্রিল মাসজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনী কামানের সাহায্য নিয়ে আমার অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। আমার ব্যাটালিয়নের ২০০ এবং ইপিআরের ২০০ সৈনিক নিয়ে তাদের প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করি। অনেক চেষ্টা করেও শত্রু বাহিনী বেনাপোল দখল করতে পারেনি। এখানে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা সগর্বে উড্ডীন থাকে।
১৯ এপ্রিল প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী বেনাপোলে আমার ব্যাটালিয়ন পরিদর্শন করেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি এদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ৬০০ তরুণকে রিক্রুট করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন রূপে গঠন করার জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দেন। এ সময় হাজার হাজার ছাত্র এবং বিভিন্ন পেশার যুবকেরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। আমি একজন বাঙালি ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে যশোর ও কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলো থেকে ৬০০ যুবককে রিক্রুট করে বেনাপোল নিয়ে আসি। ১৯৪৮ সালে বাঙালি ক্যাপ্টেন আবদুল গনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করেছিলেন। ২৩ বছর পর প্রতিকূল পরিবেশে আমার মতো জুনিয়র অফিসার এই ব্যাটালিয়ন পুনর্গঠনের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ৮ শ সৈনিক ও সরঞ্জাম নিয়ে ভারতে মেঘালয় রাজ্যের বনাঞ্চল তেলঢালায় পৌঁছালাম। তেলঢালায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের ইউনিফর্ম, প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করা হলো। পিআরসি-৭ বেতারযন্ত্রও পেলাম। নতুন অস্ত্র, সরঞ্জাম পেয়ে আমাদের মনোবল চাঙা হলো। পূর্ণ উদ্যমে রিক্রুটদের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। শান্তিকালে এদের প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল এক বছর, এখানে ছয় সপ্তাহের ক্রাশ কোর্স শুরু হলো কমব্যাটের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য। দিনের বেলা ফায়ারিং রেঞ্জে রিক্রুটদের গুলিবর্ষণের শব্দে বন্য প্রাণীরা ভীত হয়ে এলাকা ত্যাগ করে। ছয় সপ্তাহ বেসিক প্রশিক্ষণের পর নবীন মুক্তিযোদ্ধারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এবার এদের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করার পালা।
ভারতীয় সেনা কমান্ডার কামালপুর বর্ডার আউট পোস্টের পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করার জন্য মেজর জিয়াকে অনুরোধ করেন। জিয়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে কামালপুরে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন।
জামালপুর জেলার সর্ব উত্তরে অবস্থিত সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর। এখানকার বিওপিতে রক্ষণব্যূহ স্থাপন করেছে বালুচ রেজিমেন্টের ৩০তম ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি। এদের বাংকারগুলো কংক্রিটের তৈরি, চতুর্দিকে অ্যান্টিট্যাংক ও অ্যান্টিপারসোনাল মাইন বিছানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এ ধরনের ডিফেন্স পজিশনকে বলা হয় স্ট্রং পয়েন্ট। এদের সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদানের জন্য নিয়োজিত রয়েছে ছয়টি ১০৫ মিমি কামান।
মেজর মইন আমাকে ও সালাহউদ্দিনকে যথাক্রমে ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানি নিয়ে কামালপুর শত্রুঘাঁটি আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন। আক্রমণের আগে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য পর্যবেক্ষণ, অর্থাৎ রেকি করা অত্যাবশ্যক। ২২ জুলাই বিকেলে আমি প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার ফয়েজ, সিদ্দিক ও হোসেন আলীকে নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে কামালপুরে গেলাম। আমাদের পরনে মালকোঁচা মারা লুঙ্গি, উদোম গা, কোমরে লুকানো পিস্তল। বিওপির উত্তরে ফসলের খেত, মাঠে কৃষকেরা ধান কাটছে। সীমান্ত অতিক্রম করে খেতে কর্মরত কৃষকের কাছাকাছি যেতেই তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বলে, ‘ওস্তাদ আর এগোবেন না, সামনেই পাঞ্জাবিরা বসে আছে। পালিয়ে যান।’ অর্থাৎ আমাদের ছদ্মবেশ কোনো কাজে লাগেনি। শরীরের গড়ন এবং অপরিচিত মুখ সহজেই জানিয়ে দেয় আমাদের পরিচয়। একটু পরই কৃষকেরা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে গেল, জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগই পেলাম না। ফলে রেকি অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হলো।
২৩ জুলাই রাতে সালাউদ্দিন ও তাঁর প্লাটুন কমান্ডারদের নিয়ে রেকি করতে গেল। শত্রু বাংকারের কাছাকাছি পৌঁছাতেই অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল এক পাকিস্তানি সেনা। বলে, ‘হল্ট’। সালাউদ্দিন পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু বিশালদেহী পাঞ্জাবি সালাউদ্দিনকে ধরাশায়ী করে এবং তার গলা টিপে ধরে। সুবেদার হাই এগিয়ে এসে পাকিস্তানি সেনার পিঠে স্টেনের ব্যারেল ঠেকিয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘স্যার, ওপরে কে?’ সালাউদ্দিন কোনোক্রমে উচ্চারণ করে ‘ওপরে সে’। রেকি পার্টির উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি সেনা সালাউদ্দিনকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালানোর উদ্যোগ নেয়। মুহূর্তের মধ্যে হাই ও হাসেম টিজে দুজন শত্রুসেনাকে গুলি করে হত্যা করে। তারা দুটি জি-৩ রাইফেল এবং বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ ব্যাজ নিয়ে বীরদর্পে ফিরে আসে। তেলঢালায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু আমার ও সালাউদ্দিনের রেকি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আমি ও সালাউদ্দিন টার্গেট এলাকা ভালোভাবে রেকি করার জন্য কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে অনুরোধ জানালাম আক্রমণ ১৫ দিন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি জানালেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আক্রমণের তারিখ পেছাতে রাজি নয়। ১ আগস্ট ভোর ৪টা ৩০ মিনিট আক্রমণের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হলো।
কামালপুর বিওপি আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলো। ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানি উত্তর দিক থেকে, অর্থাৎ সামনাসামনি আক্রমণ চালাবে। বিওপির দুই মাইল দক্ষিণে উঠানিপাড়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে আলফা কোম্পানি রোড ব্লক স্থাপন করবে কামালপুরকে সাহায্যকারী পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর একটি মাউন্টেন ব্যাটারি আক্রমণকালে ফায়ার সাপোর্ট প্রদান করবে।
৩১ আগস্ট সূর্যাস্তের পর প্রথম ইস্টবেঙ্গলের তিনটি কোম্পানি কামালপুরের উদ্দেশে ট্রাকযোগে যাত্রা করে। যাত্রাপথে ঘণ্টাখানেক ধরে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। সৈনিকেরা সবাই ভিজে জবজবে, আমি কভার্ড জিপে থাকায় তেমন ভিজিনি, কিন্তু সালাউদ্দিন ভিজেছে। রাত ১১টার দিকে আমরা ট্রাক থেকে নেমে ভারতীয় মহেন্দ্রগঞ্জ বিওপির কাছাকাছি ঘন জঙ্গলে একটি জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত ডাকবাংলোয় অবস্থান নিলাম (অ্যাসেম্বলি এরিয়া)। এখানেই মিটিং হলো ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারির ব্যাটারি কমান্ডারের সঙ্গে। আমি ও সালাউদ্দিন কামানের ফায়ার প্ল্যান নিয়ে মতবিনিময় করলাম। স্থির হলো আমাদের দুটি কোম্পানি এফইউপিতে ( ফর্মিং আপ প্লেস) পৌঁছানোর পর আমি ব্যাটারি কমান্ডারকে বেতার সেটে সংকেত দিলে তিনি ছয়টি কামান থেকে ১০ মিনিট অবিরাম গোলাবর্ষণ করবেন শত্রু অবস্থানে। শত্রুর স্মল আর্মস রেঞ্জের বাইরে টার্গেটের সাধারণত ৬০০ থেকে ৭০০ গজ দূরে
আক্রমণকারীদের জন্য সুবিধাজনক স্থানকে এফইউপি রূপে নির্ধারণ করা হয়। এখানে আক্রমণকারী সৈনিকেরা শত্রু ডিফেন্সকে সামনে রেখে পাশাপাশি দাঁড়ায়, রাইফেলে বেয়নেট ফিক্সড করে। এখান থেকেই এইচ আওয়ারে সৈনিকেরা ফাইনাল এসল্টে শত্রুর ওপর দ্রুত পদক্ষেপে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রাত একটা বাজে। আমাদের সৈনিকেরা ডাকবাংলোর আশপাশে গাছতলায় শেষবারের মতো বিশ্রাম নিচ্ছে। পরনের ভেজা কাপড় শরীরের উত্তাপে কিছুটা শুকিয়ে এসেছে, এক মগ চা খেয়ে শরীর চাঙা হলো। সবার মনোবল তুঙ্গে। আমাদের দুটি কোম্পানিতে সদ্য যোগদানকারী সৈনিকের সংখ্যা শতকরা ৭৫ জন, যুদ্ধক্ষেত্রে আজই তাদের প্রথম দিন।
অ্যাসেম্বলি এরিয়ার ডাকবাংলো ছেড়ে আমরা নিঃশব্দে ধীর পদক্ষেপে এফইউপির দিকে এগিয়ে চলেছি। বেতার সেটে নীরবতা পালন করা হচ্ছে। সবার মনে একই প্রশ্ন দোলা দিচ্ছে, এ আক্রমণের ফলাফল কী হবে! তেলঢালা থেকে যাত্রা করার আগে মাহবুব আমাকে জিজ্ঞাসা করে ‘দোস্ত, যুদ্ধে আজ মারা গেলে দেশের মানুষ আমাদের কথা মনে রাখবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘অবশ্যই। আমাদের নাম ইতিহাসে লেখা হবে। ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীরা এসব মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে যাবে।’ পরিত্যক্ত ডাকবাংলোয় একটি কাঠের চৌকিতে শুয়ে আমি ও সালাউদ্দিন বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। সৎমায়ের সংসারে তাঁর বাল্যকাল কেমন কেটেছে, সালাউদ্দিন প্রথমবার আমাকে শোনাল। আমাদের পরিবার কোথায় আছে, কেমন আছে, কেউ জানি না। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় গুন গুন করে গাইছে ‘এইচ্যা কথা কইও না...’
নির্ধারিত সময়ে এফইউপিতে পৌঁছার পরপরই শত্রুর কামানের গোলা বিকট শব্দে আমাদের আশপাশে পড়তে থাকে। আমি ভারতীয় ব্যাটারি কমান্ডারকে গোলাবর্ষণের সংকেত দিলাম। দূরে গান পজিশনে অল্প কয়েকটি গোলাবর্ষণের শব্দ পেলাম। কিন্তু একটি গোলাও শত্রুর ডিফেন্সে পড়েনি। মিনিট দুয়েক পরই আমার বেতার সেট বিকল হয়ে পড়ে। ফলে, অন্য কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। দুই কোম্পানির আক্রমণে কমান্ডিং অফিসারের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু মেজর মইন ভারতীয় সীমান্তের ওপারে রয়ে গেলেন।
এফইউপিতে বিকট শব্দে শত্রুর কামানের গোলা পড়তেই আমাদের নবীন সৈনিকেরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু আমি ও সালাউদ্দিন তাদের সংগঠিত করে শত্রু বাংকারের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার প্লাটুন কমান্ডাররা ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে ‘খবরদার জওয়ান, কেউ পেছনে তাকাবে না। আগে বাড়ো। আল্লাহু আকবর।’ এফইউপি থেকে বেরিয়েই মাইনফিল্ডে পড়ে গেলাম আমরা, কয়েকজন হতাহত হলো। আমি ও আমার সিগন্যালার সিরাজ পাশাপাশি এক ফুট দূরত্ব রেখে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এগিয়ে চলেছি। বেতার সেট তার পিঠে, হ্যান্ডসেট আমার হাতে। ডেলটা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ একটি মাইনের আঘাতে সিরাজের বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং সে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এক ফুট ডানে পা পড়লে আমারও একই অবস্থা হতো। বেতার সেট আরেক সৈনিকের পিঠে তুলে দিয়ে আমরা দ্রুত এগিয়ে গেলাম।
শত্রু কামানের গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। যেখানেই গোলা পড়ে, বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়। তাদের মেশিনগান অবিরাম ট্যাট ট্যাট গুলিবর্ষণ করছে। বাংকারের অভ্যন্তরে থাকায় তাদের দেখতে পাচ্ছি না। তারা আমাদের অগ্রসরমাণ পুরো শরীর দেখতে পাচ্ছে। আমরা শুধু গুলির ফ্লাশ দেখছি। ভারতীয় কামানের একটি গোলাও শত্রুর রক্ষণব্যূহে পড়েনি। এ কারণেই তারা ঠান্ডা মাথায় আমাদের মেশিনগানের শিকার বানাতে পেরেছে।
একসময় ভোরের আলো ফুটে ওঠে, অন্ধকার কেটে যায়। আমরা শত্রু ডিফেন্সের পূর্ব প্রান্তে কিছুটা অংশ দখল করেছি। শত্রু বাংকার থেকে বেরিয়ে আমাদের অবস্থানে কাউন্টার অ্যাটাক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, উচ্চ স্বরে গালি দিচ্ছে আমাদের। আমি রানার পাঠিয়ে ডেলটা কোম্পানির অবস্থান জানার চেষ্টা করছি, এমন সময় আমার কোম্পানির সুবেদার খায়রুল বাশার হামাগুড়ি দিয়ে আমার অবস্থানে এসে জানাল, ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানির অর্ধেক সৈনিক হতাহত হয়েছে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হয়েছেন। লে. মান্নানও আহত হয়েছেন। এ সংবাদ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একটু পরই ১০ ফুট দূরে একটি মর্টারের গোলা সশব্দে বিস্ফোরিত হয়। আমার শরীরের তিনটি স্থানে ধারালো স্প্লিন্টার ঢুকে যায়, রক্তে শার্ট ভিজে গেল। এ পর্যায়ে আমি আমার কোম্পানিকে পিছিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম।
আমাকে দুজন সৈনিক ধরাধরি করে পেছনে ভারত সীমান্তে নিয়ে আসে। অধিকাংশ মৃতদেহ শত্রুর বাংকারের ১০ থেকে ২০ গজের মধ্যে থাকায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কামালপুর আক্রমণে আমাদের মোট ৩০ জন শহীদ এবং ৬৬ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। শত্রুরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছ, প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। সেদিন রাতে তুরা মিলিটারি হাসপাতালে ভারতীয় ডাক্তার আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করে তিনটি শেলের টুকরা বের করেন। তিন দিন হাসপাতালে থেকে তেলঢালা ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
কামালপুর আক্রমণের পর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। ডিসেম্বরে ভারতীয় ৭০০ সৈনিকের ব্যাটালিয়ন ট্যাংক ও কামানের সাহায্য নিয়ে এ ঘাঁটি দখল করেছিল। তাদের সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল গিল এখানেই মাইন ব্লাস্টে আহত হয়েছিলেন। ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং সম্বল করে আমাদের নবীন যোদ্ধারা কামানের সাহায্য ছাড়াই শত্রুর মাইনফিল্ড, গোলাবর্ষণ অতিক্রম করে কীভাবে প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো শত্রুর বাংকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এ কথা ভেবে আজও আনন্দে, বিস্ময়ে অভিভূত হই। দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের কণ্ঠ নিঃসৃত গুন গুন করে গাওয়া আঞ্চলিক ভাষার গান ‘এইচ্যা কথা কইও না...’ মনে উদয় হলে অশ্রুসিক্ত হই। মাতৃভূমি তাদের কাছে এত প্রিয় ছিল, অবলীলায় মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিয়েছে এই হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্ররা।
ক্যাপ্টেন মাহবুব ২৮ নভেম্বর গৌরীপুরের যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করে। কামালপুরে যাত্রার প্রারম্ভে মাহবুব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘দোস্ত, আজ মারা গেলে দেশবাসী কি আমাদের মনে রাখবে?’ এক চীনা সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে তার শেষ ইচ্ছার কথা সহযোদ্ধাদের কাছে লিখে পাঠিয়েছিল। আমার এক বন্ধু ফেসবুকে এর ইংরেজি অনুবাদ আমাকে পাঠিয়েছে:
‘ইফ আই ডাই ইন ওয়ার জোন
বক্স মি আপ অ্যান্ড সেন্ড হোম
পুট দ্য মেডেলস অন মাই চেস্ট,
টেল মাই মম, আই ডিড বেস্ট।
টেল মাই নেশন নট টু ক্রাই
ফর আই অ্যাম আ সোলজার বর্ন টু ডাই।’
[লড়াইয়ের ময়দানে এই সেনা যদি মরে যায়
কফিনে শুইয়ে লাশ বাড়ি পাঠিয়ো
পদক সাজিয়ে রেখো আমার সিনায়
শেষাবধি লড়ে গেছি, মাকে জানিও।
কাঁদতে বারণ করো এ জাতিকে, আর
বলে দিয়ো, আমি সেনা—
শহীদ হবার তরে জন্ম আমার।]
অতএব, হে দেশবাসী, কামালপুরের যোদ্ধাদের জন্য কেঁদো না, দেশের জন্য মরবে বলেই তো তারা জন্মেছে।
লেখক : হাফিজউদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, বীর বিক্রম।
সান নিউজ/এনএম