মোস্তফা কামাল
প্রকৃতির সম্পৃক্ততা সবখানেই। তা রোগবালাই থেকে শুরু করে দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও। চলমান করোনা মহামারির পেছনেও প্রকৃতির খেয়াল নিয়ে গবেষণা চলছে। এরই মাঝে ধরন পাল্টে করোনা আরো আগ্রাসী। লাশের সংখ্যা তুলনায় কম হলেও বজ্রপাতও দেখা দিয়েছে করোনার দোসর হয়ে। ভূমিকম্পও একের পর এক আঘাত হেনে চলছে। পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড় ধস ও প্রাণহানির শঙ্কা জানিয়ে মাইকিং চলছে। সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে ঝুঁকিতে বসবাসরতদের।
প্রকৃতি কারো প্রতি অবিচার করে না। কাউকে ছাড়ও দেয় না। তার চলতি পথে কেউ ছেদ ফেললে খ্যাপে। যথাসময়ে যথানিয়মে যা করার সেটাই করে। তা কখনো নগদে। কখনো বাকিতে। তবে দেরিতেই বেশি শোধ নেয়। প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণের বিশ্বাস মোটামুটি এমনই। করোনা মহামারি ছাড়াও মাথাফাটা রোদ, ভ্যাপসা গরম, বন্যা, খরা, হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি, ভূমিকম্প-বজ্রপাত ইত্যাদির সঙ্গে প্রকৃতির যোগসাজশ রয়েছে বলে বিশ্বাস অনেকের। সবসময় না হলে সম্প্রতি বিশ্বাসটির মৌখিক স্বীকৃতি শোনা যায় অনেকের মুখে।
প্রকৃতির প্রতি চরম অবিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ, নদীশাসন প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা প্রভাবজনিত কারণে বাংলাদেশের বিপদাপন্ন হওয়ার শঙ্কা কেবল বাড়ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি দেশের দীর্ঘদিনের অর্জিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি দুর্যোগের কারণে বিলীন হওয়ার শঙ্কা ভর করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ রুখতেই হবে। পরিবেশ বিপদাপন্ন হলে তা দুর্যোগ-ঝুঁকিকে ত্বরান্বিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বহার এবং এর প্রভাব বাংলাদেশকে আরো বিপদাপন্ন করার হাতছানি দিচ্ছে।
প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর আঘাতের পাল্টা আঘাত অনিবার্য। করোনার মতো মহামারি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ এবং খরার মতো আপদ তার উদাহরণ মাত্র। পৃথিবীতে মহামারি আগেও এসেছে। বিদায়ও নিয়েছে। মানুষও থেমে থাকেনি।
স্মরণ করতেই হয় শত বছর পরপর বিশ্বে কোনো না কোনো মহামারি হানা দেয়। কিন্তু গত কয়েক শতকেও মানবজীবনের গতিতে এমন ধকল আর আসেনি। করোনায় ২০২০ সাল থেকে জীবন-জীবিকায় জেঁকে বসা এমন দুর্গতি ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, ১৮২০ সালে কলেরা বা ১৭২০ সালে প্লেগের সময়ও হয়নি। এবার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে কী অবস্থা হবে সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ নাজুক অবস্থানে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আসছে। এসব ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড়, টর্নোডো, নদীভাঙন, উপকূলভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ প্রভৃতি।
এছাড়া সিসমিক জোন অর্থাৎ ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন শুধু বাড়ছে।
এবার গত ক’দিনের বজ্রপাত ও মৃত্যু সংখ্যা বাজে শঙ্কা দিচ্ছে। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিপর্যয়ের জেরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়বে, এমন আভাস দেয়া হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। সেটা ফলতে শুরু করেছে এপ্রিল থেকে। তা বেড়েই চলছে। গত মধ্য এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত বজ্রপাতে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বজ্রপাতের বেশি প্রবণতার দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জনের।
এই হিসাবে দেশে গড়ে প্রতি বছর মৃত্যু সংখ্যা ২১৬। এত বজ্রপাতের মূল কারণ আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে পাহাড়ি এলাকা। কিছু দূরেই হিমালয়। সেখান থেকে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাতাস। এই দুই বাতাসের যোগফলে বজ্রপাত। বজ্রপাত নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছেন, এর পেছনেও রয়েছে প্রকৃতির গতিতে বাধা দেয়ার জের।
দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে এখন মোবাইল ফোন আছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল ফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ার রয়েছে। দেশের কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। তাছাড়া সন্ধ্যার পরে মানুষের ঘরের বাইরে অবস্থান বাড়ছে। আর বেশির ভাগ বজ্রপাতই হয় সন্ধ্যার দিকে।
আবহাওয়াবিদ বা বিশেষজ্ঞদের কাছে বজ্রপাত ঠেকানোর দাওয়াই নেই। আছে সতর্কতার নির্দেশনা। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বজ্রঝড়ের সময় ঘরের বাইরে না যাওয়া, জরুরি দরকারে বের হলে পায়ে রাবারের জুতা পরা, বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়া, বজ্রপাতের শঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া, ভবনের ছাদ বা উঁচু ভূমিতে না যাওয়া, গাড়ির ভেতর থাকলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না রাখা ইত্যাদি।
দেশে এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে এবং হাওর এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয়। কিন্তু গত ক’দিন হাওর এলাকার বাইরে বজ্রপাত ও মৃত্যুর ঘটনা বেশি। বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য মতে, গত দেড় মাসে বজ্রপাতে মৃত্যু ২০০ প্রায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল এই ১১ বছরে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৯ জন।
২০২০ সালে বজ্রপাতে মারা গেছে ২৯৮ জন। তবে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২০১৮ সালে, ৩৫৯ জন। ২০১৭ সালে মারা গেছে ৩০১ জন। ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন এবং ২০১০ সালে ১২৩ জন বজ্রপাতে মারা যান।
এবারের বর্ষায় নদীভাঙন তীব্র হওয়ার আভাস দিয়েছে বাড়তে পারে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস। তাদের পূর্বাভাস বলছে, দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ বছর ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে পারে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর।
তবে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিইজিআইএসের পূর্বাভাসের তালিকায় না থাকলেও শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় গত দুই বছর তীব্র ভাঙন দেখা যায়। এই তিন জেলায় এবারো নদী-তীবরর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিতে পারে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশে নদীভাঙন কম ছিল। এমনকি চাঁদপুর, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়ার মতো তীব্র ভাঙনপ্রবণ এলাকায়ও ভাঙন অনেকটা কমে যায়।
কিন্তু ২০২০ সালে এসে পরিস্থিতি আবার পাল্টাতে থাকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ। কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে রুদ্র প্রকৃতি থেকে নিষ্কৃতির সাধ্য কারো হচ্ছে না।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।