শ্যামল দত্ত
করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে সবচেয়ে ক্ষতি করে ফুসফুসের। এই ক্ষতির পরিমাণ ৪০ শতাংশের বেশি হলেই মৃত্যু অবধারিত। আইসিইউ বা লাইফ সাপোর্টেও জীবনকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিজ্ঞান বলছে, ফুসফুস প্রতি নিশ্বাসে ৫০০ মিলিলিটার করে দিনে প্রায় ১১ হাজার লিটার বাতাস পাম্প করে।
এর মধ্যে ২ হাজার লিটারের বেশি থাকে অক্সিজেন। এখন দেখছি ইউনাইটেড গ্রুপ নামক একটি ভাইরাস চট্টগ্রামের অক্সিজেন দেয়ার ফুসফুসে আঘাত হানছে। একটি করোনা ভাইরাস যখন একজন মানুষের ফুসফুসে আঘাত হানে, তখন দ্রুত মৃত্যু ডেকে আনে রোগীর। এখন একটি ব্যবসায়ী ভাইরাস পুরো একটি শহরের ফুসফুস খেয়ে ফেলতে চাইছে। করোনার চাইতেও ভয়ংকর এই ব্যবসায়ী ভাইরাস! তবে চট্টগ্রামের মৃত্যু কি প্রায় আসন্ন?
চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকাটি যারা নিজের চোখে দেখেননি, তাদের পক্ষে ধারণা করাই কঠিন। কী অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই এলাকাটি। শতবর্ষী শিরীষ গাছগুলোর ছায়া স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় পুরো এলাকায়। চট্টগ্রামের মানুষ শ্বাস ফেলতে চলে যায় এই সিআরবিতে। ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ শাসকরা আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার হিসেবে চট্টগ্রামে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি স্থাপন করার পেছনে ছিল একটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। আসাম ও সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত চা চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে এসে রপ্তানি ও রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারতের নানা রকমের পণ্য রপ্তানি করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।
আঠারো শতকের শেষের দিকটা ও উনিশ শতকের প্রথম কয়েক বছর ঢাকার নবাব ও মুসলিম জমিদারদের পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে আলাদা রাজ্য করার যে আন্দোলন চলছিল, সেই রাজ্য পরিকল্পনায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবস্থান ছিল অন্যতম। বন্দর হিসেবে তখন যদিও কলকাতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো, কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে চট্টগ্রামের বন্দরকে গুরুত্ব দেয়ার আকাক্সক্ষাটি ছিল বেশি। পূর্ববাংলা এবং আসামকে নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠনে গভর্নর লর্ড কার্জনের সমর্থন থাকায় সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় তারই প্রচেষ্টায়।
১৯০৬ সালে পূর্ববাংলার কয়েকটি জেলা ও আসামকে নিয়ে আলাদা একটি রাজ্যের স্থায়িত্ব হয়েছিল মাত্র ৬ বছর। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নেতৃত্বে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন এতটাই তুঙ্গে উঠেছিল যে, ব্রিটিশরা একপর্যায়ে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে রাজধানী নিয়ে গেল দিল্লিতে এবং বাংলা থেকে ছেটে ফেলল বিহার ও উড়িষ্যাকে।
তবে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার হিসেবে চট্টগ্রামের অপরিসীম গুরুত্ব থাকায় সেটি অব্যাহত ছিল। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়েকে যমুনা নদীর দুই পাড় পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে ভাগ করা হলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলের হেডকোয়ার্টার হিসেবে চট্টগ্রামের এই সিআরবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রেলের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেডকোয়ার্টার হচ্ছে রাজশাহীতে।
চট্টগ্রামের নগরীর অপূর্ব উঁচু-নিচু পাহাড়ের নৈসর্গিক এই ভূমির মধ্যে অবস্থিত সিআরবিতে এতদিন কোনো ব্যবসায়ীর লোলুপ দৃষ্টি পড়েনি। সমুদ্র, নদী আর পাহাড়কে নিয়ে যে চট্টগ্রাম হতে পারত অসাধারণ একটি মনোরম শহর সেই শহরকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া যখন প্রায় চূড়ান্ত, তখন সিআরবিতে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর।
এর আগে ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মিষ্টি পানির সংস্থান করতে গিয়ে তৈরি করা ফয়েজ লেক ছেড়ে দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। বিএনপি আমলে রেলের দায়িত্বে থাকা এক মন্ত্রী নিজের মানবাধিকার সংস্থার নামে ফুলবাড়িয়ার রেলের জমি বরাদ্দ নিয়েছেন। চট্টগ্রামে রেলের বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ নির্ধারণ করার দায়িত্ব কারো নেই বলেই মনে হয়। অন্যদিকে আউটার স্টেডিয়ামের খেলার মাঠে গড়ে উঠেছে মার্কেট।
অথচ এই মাঠেই একসময় অনেক নামিদামি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়েছে। খেলার জন্য তৈরি করা স্টেডিয়াম এখন পরিচিতি পেয়েছে খাবারের হোটেলের এলাকা হিসেবে। বাংলা নববর্ষ বরণসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য পরিচিত ডিসি হিল পার্ক এখন ডিসির নিরাপত্তা অজুহাতে সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র পাহাড় কেটে গড়ে তোলা সুউচ্চ ভবন ঢেকে ফেলেছে চট্টগ্রামের নয়নাভিরাম পাহাড়গুলোকে।
পুরনো আর্ট কলেজ বা সারসন রোডের নির্জন ওয়ার সিমেট্রি এলাকা এখন গিজগিজ করছে অ্যাপার্টমেন্টের ভিড়ে। ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে নির্মিত হয়েছে দোকানপাট। নিউমার্কেট চৌরাস্তায় ছোট্ট একটি পার্ক ভেঙে বানানো হয়েছে মার্কেট। ড্রেনের উপর কিংবা পেট্রলপাম্পের উপরে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। একটি অপূর্ব নগরকে নির্মমভাবে ধ্বংসের দ্বিতীয় নজির পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিআরবির পিছনে উঁচু-নিচু পাহাড়ের টাইগারপাস এলাকাটি একসময় বিখ্যাত ছিল বাঘের নিরাপদ চলাচলের জন্য।
আরেকটু সামনে এগুলেই পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব, যেখানে বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৯৩৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহীরা আক্রমণ করেছিল, সেই জায়গাটি এখন রেলওয়ে একাউন্টস অফিস বানিয়ে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। সার্কিট হাউসের সামনের খোলা মাঠটিকে একটি নিম্ন মানের শিশুপার্ক বানিয়ে এর পুরো নান্দনিকতাকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
এক সময় চট্টগ্রামবাসী সন্ধ্যার পরে এই মাঠে দারুল কাবাবের মনোরম সব কাবাব উপভোগ করত। এখন শুনছি শহীদ মিনার ভেঙে ওই এলাকায়ও একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, চট্টগ্রামকে ধ্বংস করার প্রায় সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন। ধ্বংসের সেই প্রক্রিয়ার কফিনে এখন শেষ পেরেকটি ঠোকা হচ্ছে সিআরবিতে ইউনাইটেড গ্রুপ নামের একটি ব্যবসায়ী সংস্থাকে ৫শ বেডের হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করতে ৫০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।
কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই খুব গোপনে বেশ কয়েক বছর আগে সরকারের অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এখানে সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের ভিত্তিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনিতে এই এলাকায় রেলওয়েল একটি হাসপাতাল আছে।
পাশে গড়ে উঠেছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমি। এর মধ্যে যদি হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট আর মেডিকেল কলেজ নির্মিত হয়, তাহলে পুরো এলাকা তার নিজস্ব বৈচিত্র্যকে হারিয়ে ফেলবে। অথচ এই এলাকাকে ‘হেরিটেজ’ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। শতবর্ষী শিরীষ গাছগুলোকে পিষে ফেলবে হাসপাতালটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ভবনের পর ভবন।
এই ইউনাইটেড গ্রুপ রাজধানীর গুলশান এলাকায় লেকের পাড়ে হোটেল নির্মাণ করার কথা বলে আবাসিক এলাকায় নির্মাণ করেছে ৩৫০ বেডের একটি হাসপাতাল। ২০০৬ সালে বিএনপি আমলে গড়ে তোলা এই হাসপাতালটি কিভাবে চারপাশের অভিজাত আবাসিক ভবনের মাঝখানে হাসপাতাল পরিচালনার অনুমতি পেল তা নিয়ে নানা কানাঘুষা আছে। সেই সময়কার বিখ্যাত একটি ভবনের সঙ্গে এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যোগাযোগের কথা অনেকে বলেন।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে বিএনপিপন্থি ওই গ্রুপটি এই সরকারের আমলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি প্লান্ট স্থাপনসহ বিভিন্ন খাতে এই গ্রুপের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। গত বছর ইউনাইটেড হাসপাতালের পার্কিং এলাকায় অস্থায়ী করোনা ইউনিট স্থাপন করা হয়েছিল সরকারের কোনো অনুমতি না নিয়ে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে আগুন ধরে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন ৫ জন করোনা রোগী পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। ঘটনার তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করা হলেও সেই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে আদালতের নির্দেশে কিছু দায়সারা ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেহাই পেয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই ইউনাইটেড গ্রুপকেই আবার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে তারা প্রকল্প নির্মাণের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে, ভেঙে ফেলেছে শ্রমিকদের কিছু বাসভবন এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এই কাজের জন্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করেছে। কি বিচিত্র এই দেশ!
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এসব অপকর্ম রুখে দাঁড়ানোর জন্য চট্টগ্রামে এখন আর কোনো সুদৃঢ় নেতৃত্ব নেই বললেই চলে। বিভিন্ন ঐতিহ্যময় এলাকা ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো লুটেপুটে খাচ্ছে বিভিন্ন নামের ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন। পেছন থেকে মদত দিচ্ছে নানা রাজনৈতিক শক্তি।
এসব অন্যায় কাজে রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে সব আদর্শ ও বিশ্বাসের দল এক হয়ে যায়। সম্প্রতি রহমতগঞ্জের যাত্রা মোহন সেনের ঐতিহাসিক বাড়ি দখলের সময়ে একই চিত্র দেখা গেছে। চট্টগ্রামে ভূমি দখল, পরিবেশ ধ্বংস ও নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে রাজনীতি ও ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে একটা অদ্ভুত সখ্য আছে। রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিভাজন এখানে কোনো বিষয় নয়।
চট্টগ্রামের সব দলের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মাঝরাতের একটি আঁতাত বলে কথা প্রচলিত আছে। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত- সবাই এক কাতারে। নিজেদের স্বার্থের প্রশ্নে রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাস ভুলে তারা সবাই এক হয়ে যান। যে কারণে সিআরবিকে ধ্বংস করার ব্যাপারে নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ গড়ে তুললেও নানা মত ও বিশ্বাসের রাজনীতিবিদরা বলতে গেলে প্রায় নিশ্চুপ। বরং কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এই স্থাপনা নির্মাণের পক্ষে কথা বলছেন প্রকাশ্যে।
রাজনীতিবিদদের এই নীরবতার মধ্যে নগরের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার সেই মাঝরাতের আঁতাতের ভূত দেখছেন অনেকে। সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মাহবুবুল আলম ও আবুল ফজলের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক শহর চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য বোধহয় এখানেই।
সান নিউজ/এমএম