নাদিয়া নাহরিন রহমান
আচ্ছা, একটা সাধারণ প্রশ্ন করা যাক। নারীদের পোশাকে কেন পকেট থাকে না? (যদিও এখন পরিবর্তন এবং প্রয়োজনের তাগিদে কিছু ক্ষেত্রে পোশাকে এর প্রচলন দেখা যাচ্ছে)। যেমন- অধিকাংশ ঘটনার পেছনেই রাজনৈতিক-অর্থনীতি থাকে, তেমনি নারীর পোশাকে পকেট না থাকার ব্যাপারটিতেও রয়েছে এই রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
ব্যাপারটিকে একটু ব্যাখ্যা করা যাক। যেহেতু আগেকার সমাজ কাঠামো অনুযায়ী নারীদের যে কোনো অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট থাকাই ছিল এক ধরনের বিলাসিতা, সেহেতু তার পোশাকে পকেট না থাকাটাই স্বাভাবিক। নারী তো অর্থকেন্দ্রিক কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। তাহলে শুধু শুধু পোশাকে পকেট কেন থাকবে? তার সব পরিকল্পনা এবং কাজ হবে গৃহকেন্দ্রিক।
যদিও নারী গৃহের বাইরে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে এসেছে বহুকাল আগে থেকেই, কিন্তু এর স্বীকৃতি মিলেছে খুব কমই। বছর এবং যুগ ঘুরে হাওয়া বদল হলেও খুব একটা পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই না। হ্যাঁ, নারীর পোশাকে বিভিন্ন পরিবর্তন এবং পকেটের সংযোজন হলেও কর্মক্ষেত্রে এখনও বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন রকমের বিভেদের মধ্যে এই আধুনিক যুগে একটি হলো 'গ্লাস সিলিং প্রভাব'।
গ্লাস সিলিং বা কাচের দেয়াল সাধারণত রূপক অর্থে বলা হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি যখন সূক্ষ্ণ কিছু বাধার মুখোমুখি হন, যা তাকে সম্মুখে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করে, তখন এই বিষয়কেই রূপক অর্থে বলা হয় গ্লাস সিলিং প্রভাব। যোগ্যতা এবং কাজের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিকে যখন তার নির্দিষ্ট কাজ এবং পদমর্যাদা দেওয়া হয় না, তখনই তাকে গ্লাস সিলিং প্রভাব বলা যেতে পারে। কর্মপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ব্যক্তিই কোনো না কোনো সময়ে এরকম বাধার সম্মুখীন হন।
তবে বেশ কয়েকটি গবেষণা এবং পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরাই এর সম্মুখীন হন বেশি। অর্থাৎ নারীরা কর্মক্ষেত্রের একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও করপোরেট সিঁড়ির একটা ধাপে এসে ঠিকই আটকে যায়।
যেমন- আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী একজন নারী ও পুরুষ সমপরিমাণ কাজ করেও সমান পরিমাণ আয় করেন না। একই পরিমাণ শ্রম বিনিয়োগ করেও যেখানে পুরুষ আয় করছেন ১০০ টাকা, সেখানে নারী তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাচ্ছেন ৭৯ টাকা। আয়ের বেশিরভাগই যাচ্ছে পুরুষের পকেটে।
এই বিপুলসংখ্যক কর্মরত নারী করপোরেট জগতে পরিণত হচ্ছেন সস্তা শ্রমিক হিসেবে। এপিকিউটিভসহ বিভিন্ন উচ্চ পদে নারীর উপস্থিতি খুব কমই চোখে পড়বে আপনার। এর জন্য যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয় নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়, শারীরিক এবং সমাজের নানা প্রতিকূলতার অজুহাত। এই চিত্র কেবল এপিকিউটিভ বা অন্যান্য উচ্চ পদেই নয়, বরং চোখে পড়বে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। উইমেন ইন এপিকিউটিভ পাওয়ার বইটিতে বলা হয়, পরিবার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পর্যায় পর্যন্ত নারীকে নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয় বহুবার এবং বহুভাবে।
কালের আবর্তে পরিবর্তন এসেছে অনেক কিছুতেই। গৃহের সীমানা ছেড়ে আধুনিক এই সময়ে শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ প্রতিটি পর্যায়ে নারীর পদার্পণ রয়েছে উদাহরণ দেওয়ার মতো। কিন্তু ভিত্তিপ্রস্তর যদি সূক্ষ্ণভাবে যাচাই করা যায়, তবে দেখা যাবে- পরিবর্তন এখানে অনেকটাই বাহ্যিক।
আমরা নিজেদের আধুনিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এখনও আমাদের প্রতি বছর ঘটা করে নারী দিবস পালন করতে হয়। আবার বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে এই নারীদের উপস্থিতিই উদাহরণ হিসেবে রাখার চেষ্টা সব সময় যেমন ইতিবাচক নয় নারীদের জন্য, ঠিক তেমনি পুরুষের জন্যও!
প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
Email: [email protected]
সান নিউজ/এমএম