তুষার আবদুল্লাহ
সবার হাতে গজ ফিতা। সকলেই মেপে দেখার অপেক্ষায়। যা মাপা হবে তার আকার সম্পর্কে সবারই পূর্ব জ্ঞান আছে। যেমন, আকারের কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবতা ভিন্ন। ‘কঠোর’ শব্দটি করোনাকালের গোড়া থেকেই শোনা হয়ে আসছে। যখন যত কঠোরতার কথা বলা হয়েছে– গিঁট ততই সরল হয়েছে। সীমিত ও বিধি- নিষেধের সুতোর টানে খুলে পড়েছে কঠোরতার বসন। কঠোরতার হুংকারের পরপরই ছিল সীমিত পরিসরের বিশাল ছাড়। এই ছাড়টিও পরিকল্পিতভাবে দেওয়া হয়নি। উড়োজাহাজ চলাচল খোলা রেখে বন্ধ রাখা হয়েছে বাস, ট্রেন, লঞ্চের মতো গণপরিবহন। কিন্তু আটকে রাখা যায়নি ঢাকামুখী ও গ্রামমুখী মানুষ। সামাজিক দূরত্বকে দেওয়া হয়েছিল ঘনত্ব। ঠিক যে সময়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রাখার প্রয়োজন ছিল, সীমান্ত বন্ধ করা অনিবার্য ছিল, কখনও সেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দেরি হয়ে গেছে সবসময়ই।
দোকান বিপণি-বিতান খোলা হলো, বিষয়টি এমন যে অদৃশ্য অনুজীব রাত আটটা বা দশটার পরে সক্রিয় হয়। আন্তঃজেলা বাস দেখলেও সংক্রমণের থাবা গুটিয়ে নেবে অনুজীবটি। বিদ্যায়তন ছাড়া সকল অফিস আদালত, বাজার হাটকে সমীহ করে চলবে অদৃশ্য অনুজীব। এই অজুহাত হাতিয়ার করে, কঠোরতায় ছাড় দেওয়া হয়েছে প্রতিবার। ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টে সীমান্ত জেলা ও বিভাগগুলো যখন নাকাল, এবং ওই চরিত্র নিয়ে কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউ ঢাকামুখী, তখন আবার ঘণ্টা বেজেছে লকডাউনের। সুপারিশ এসেছিল ১৪ দিনের শাটডাউনের। সেখানে শুরুতেই ছাড় পেয়ে আসছে ৭ দিনের লকডাউন। বলা হচ্ছিল, লকডাউন এবার কঠোর হবে। বিজিবি, সেনা মোতায়েনের কথাও বলা হচ্ছিল, শুক্রবার রাতে। শনিবার সকালের মধ্যে সেই কঠোর লকডাউনের ছাড়ের আভাস মিললো আবারও।
জুন সমাপনী উপলক্ষে সীমিত আকারে রাজস্ব আদায় বিভাগ খোলা রাখা হবে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় খোলা থাকবে পোশাক তৈরি কারখানা। পোশাক শ্রমিকরা কাজে যাবেন কীভাবে? তাদের কাজের জায়গার দূরত্ব কতটা বিধি মেনে রক্ষা করা সম্ভব? পোশাক শ্রমিকরা বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় আসা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা কতটা নিশ্চিত করা যাবে? এর কোনও সদুত্তর নেই। পোশাক মালিকরা বলবেন, তারা নিজ নিজ কারখানার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। কিন্তু পথ আর শ্রমিকের আবাসে সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে উপরওয়ালার ভরসা ছাড়া সকলই নিরুপায়।
শাটডাউন আসছে শুনেই ঢাকা থেকে মানুষ গ্রামে ছুটতে শুরু করেছিলেন। লকডাউনের সিদ্ধান্ত আসা মাত্র সড়ক মহাসড়কে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। গণপরিবহন বন্ধ আছে, কিন্তু মানুষ সড়ক মহাসড়কে ট্রাক অটো রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল যা পাচ্ছে, তাতেই চড়ে বসছেন। কোথাও কোথাও কিছু বাসও চলতে দেখা যাচ্ছে। এই যে যারা ঢাকা ছাড়ছেন, তারাতো ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতেও যাচ্ছেন। আবার ওদিক থেকেও মানুষ ঢাকায় আসছেন, তাহলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব হবে? কঠোর লকডাউন শুরুর আগেই সংক্রমণ বিনিময়ের পথ খোলা থাকলো শহরে প্রবেশ ও বাহির হওয়া সিলগালা করা সম্ভব না হলে, কঠোরতায় কোমলতা রয়েই যাবে।
কোমল, কঠোরতার ফাঁকে রাজ্যের সকল কর্ম চললেও, চঞ্চলতা নেই বিদ্যায়তনে। ডিজিটাল দূরশিক্ষণ চলমান থাকলেও, তা শিক্ষার্থীদের কতটা ঋদ্ধ করছে বা ওই শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে তাদের কতটা মনসংযোগ রয়েছে? তা নিয়েও তর্ক চলছে। তবে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ নিয়ে বিভক্ত মতের সুযোগ নেই। পণ্য উৎপাদন বিরতির ক্ষতি নগদে বোঝা গেলেও, শিক্ষা বিরতির ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাবে না। দূর আগামীতে আমরা সেই ক্ষতি হয়তো অনুধাবন করতে পারবো।
সাধারণের পর্যবেক্ষণ হলো– করোনাকাল বছর দুই পেরোচ্ছি, তবু আমাদের বিচলতা কাটছে না। নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারিনি। অদৃশ্য অনুজীব প্রতিরোধ, হাসপাতাল সেবা, ভ্যাকসিন কেনা, দুর্নীতি দমন সর্বত্রই কঠোর উদ্যোগের মাঝে সীমিত ছাড় রয়ে যাচ্ছে। যা দফায় দফায় আমাদের বিপর্যস্ত করে তোলে। অথচ পরামর্শক কমিটি, পেশাজীবী চিকিৎসক এবং গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষণ আমলে নিলে আমরা কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সক্ষম আছি।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী