রেজাউল করিম: আলিবর্দি খান বা সিরাজউদ্দৌলার আমলে দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান ছিল না। রবার্ট ওরমের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৭৫৪ সালে আলিবর্দির সময়ে দিউয়ান, তন-দিউয়ান, সাব দিউয়ান, বকশি- এ রকম সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুরা অলংকৃত করেছেন, একমাত্র বকশি পদটি অলংকৃত করেছেন একজন মুসলমান মীর জাফর। আবার ১৯ জন বড় জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন হিন্দু। সিরাজউদ্দৌলার সময়ে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সিরাজ কিছু পরিবর্তন করেছেন, তবে তা সাম্প্রদায়িক কারণে নয়, ব্যক্তিগত কারণে। যেমন- রায় দুর্লভরামকে দেওয়ান সুবাহ পদ থেকে সরিয়ে মোহনলালকে সে পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রীও করেন। সেনাপতি মীর মদনকে নিজস্ব রিসালা প্রধান ও তোপখানার প্রধান করেন। রাজারাম ছিলেন সিরাজের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান এবং মেদিনীপুরের ফৌজদার। দুর্লভরামের ছোট ভাই রাসবিহারীকে করেন বীরনগর গোন্দোয়ারার ফৌজদার।
সিরাজউদ্দৌলা পলাশি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে বিহারের পাটনার পথে রওনা দেন। উদ্দেশ্য- সেখানে ফরাসি সেনাপতি মঁশিয়ে লা ও পাটনার রাজা রামনারায়ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুনরায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। পথিমধ্যে তিনি ধৃত হন এবং মীর জাফরপুত্র মিরনের নির্দেশে নিহত হন। পলাশি যুদ্ধে পরাজয়ের পর বিপদের মুহূর্তেও সিরাজ ভরসা রেখেছেন হিন্দুদের ওপর। কেননা মুসলমানরা মীর জাফরের দলে ভিড়ে গেছে। হিন্দুরা সহজে মীর জাফরকে গ্রহণ করেনি। যেমন- বিহারের নায়েব নাজিম রামনারায়ণ রায় ছিলেন সিরাজের অনুগত। তিনি মীর জাফরের সিংহাসন লাভের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। সিরাজ অনুগত অনেক জমিদার বিশেষ করে পূর্ণিয়া ও মেদিনীপুরের জমিদাররা মীর জাফরকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। এদিকে মীর জাফর দিল্লিতে রাজস্ব প্রেরণ না করায় বাদশাহ শাহ আলম বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি নিলে রামনারায়ণ বাদশাহকে সমর্থন করেন। অবশ্য লর্ড ক্লাইভের হস্তক্ষেপে বিদ্রোহী জমিদাররা মীর জাফরের সঙ্গে আপসে আসতে বাধ্য হন।
যেসব কারণে মীর জাফর আলী খান, ঘসেটি বেগম, ইয়ার লতিফ, মীর কাসিম, শওকত জং, খাদিম হোসেন, রহিম খান, করম আলি খান, বাহাদুর আলী খান, খোজা ওয়াজেদ প্রমুখ সিরাজের বিরোধিতা করেছিলেন, সেসব কারণে জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদও করেছিলেন। এরা সকলেই ছিলেন নবাব আলিবর্দি খানের অনুগত ও বিশ্বস্ত। সিরাজের ঔদ্ধত্য আচরণে রাজপারিষদের বয়োজ্যেষ্ঠরা তার বিরুদ্ধে চলে যান। সিরাজ প্রকাশ্যে জগৎ শেঠকে চপেটাঘাত করেছিলেন এবং হিজড়া করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। জগৎ শেঠ ছিলেন সে আমলের বড় ব্যাংকার, টাঁকশালের মালিক। তাকে বলা হতো ব্যাংকার অব দ্য ওয়ার্ল্ড। রাজা, সম্রাট, জমিদাররা তার কাছ থেকে ঋণ নিত। দিল্লির সম্রাটদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন জগৎ শেঠ। সম্রাট ফররুখশিয়ার ফতেহচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন। দরবারে নবাবের বাম পাশের চেয়ারটি জগৎ শেঠের জন্য বরাদ্দ থাকত। জগৎ শেঠই সিরাজের নানা আলিবর্দি খানের জন্য দিল্লির সম্রাটের ফরমান এনে দিয়েছিলেন। জগৎশেঠ হিন্দু ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধর্মে জৈন এবং জাতিতে ওসওয়াল। সিরাজ ক্ষমতায় এসে রায়দুর্লভের স্থলে মোহনলালকে করেন নায়েব দেওয়ান ও প্রধানমন্ত্রী। এতে রায়দুর্লভ অপমানবোধ করেন এবং মীর জাফরের জুটি হন। নবাবের কলকাতা দখলের সময় উমিচাঁদের ৩০ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। নবাব তাকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও তিনি সে ক্ষতিপূরণ পাননি। ফলে তিনিও ইংরেজদের দলে যান। উমিচাঁদ ছিলেন শিখ ধর্মাবলম্বী। আবার সিরাজউদ্দৌলা ঘসেটি বেগমের দেওয়ান রাজবল্লভ ও তার পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে আটকের নির্দেশ দিয়েছিলেন ধর্মীয় কারণে নয়, ঘসেটি বেগমের প্রতি বিদ্বেষের কারণে। পরে নবাব সসম্মানে তাদের ছেড়ে দেন।
সুতরাং সাম্প্রদায়িক কারণে কেউ সিরাজউদ্দৌলার বিরোধিতা করেননি। যারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন, তারা তা করেন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও লোভ-লালসার কারণে। সিরাজউদ্দৌলা নিজেও সাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন না। বরং হিন্দুরাই ছিলেন তার আপনজন। যেমন মীর মদন, মোহনলাল, রাম নারায়ণ, রাজা রাম এবং এমনকি তার সহধর্মিণী লুৎফুননেসা। এরা সবাই ছিলেন হিন্দু। তখন বাংলার পরিবেশও ছিল অসাম্প্রদায়িক। তখন হিন্দু-মুসলমানের মিলনাত্মক দেবতা বা পীর সত্যপীরের বেশ প্রভাব ছিল। এর মূল স্লোগান ছিল- 'যেই রাম, সেই রহিম'।
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর
Email: [email protected]