রণেশ মৈত্র
বিগত ১৩ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অসাধারণ মর্যাদা প্রদর্শন করে একটি সুপারিশ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করার জন্য পাঠানো হয়েছে। সুপারিশটি ঐতিহাসিক, তবে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
সর্বাগ্রে দেখে নেয়া যাক, ওই সংসদীয় কমিটিতে কে কে আছেন বা ওই বৈঠকে কে কে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিবহন শ্রমিক নেতা ও এমপি শাজাহান খান। তিনিই ওই সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এবং বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন।
আর যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, রাজিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) রফিকুল আসলাম, কাজী ফিরোজ রশিদ, ওয়ারেসার হোসেন বেলাল এবং মোসলেম উদ্দিন আহমেদ। এরা সবাই সংসদ সদস্য।
বৈঠকটিতে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি তারা খুঁজে পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর গার্ড অব অনার মহিলা ইউএনওরা নিলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে ব্যাপক গবেষণায় তারা আবিষ্কার করেছেন। তবে এই গবেষণায় কত বীর মুক্তিযোদ্ধার মতামত নিয়ে অমন একটা ঐতিহাসিক সুপারিশ তারা করলেন, আশা করি স্বচ্ছতার ও নৈতিকতার খাতিরে তারা শিগগিরই তা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করবেন।
তারা তাদের সুপারিশে বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর গার্ড অব অনারে মহিলা ইউএনওরা নেতৃত্ব দিলে কোথাও কোথাও নাকি অসুবিধার সৃষ্টি হয়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। তাই এ কথাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, কোন কোন গ্রামে বা হাজার হাজার গ্রামের মধ্যে কতটি গ্রামে এমন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে? মাননীয় সদস্যরা এই সাধারণ কিন্তু সঙ্গত প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারবেন না, তাও সবার জানা।
তবে থলের বিড়াল তারাই বের করেছেন। বলেছেন, মহিলারা যেহেতু জানাজা পড়াতে পারেন না, তাই মহিলা ইউএনওদের মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব দেয়াটাও সঙ্গত নয়। তাই তারা তাদের ঐতিহাসিক সুপারিশে যেসব স্থানে মহিলা ইউএনও আছেন বা থাকবেন সেসব স্থানে বিকল্প কোনো পুরুষের নেতৃত্বে গার্ড অব অনারের ব্যবস্থা করার সুপারিশ দিয়েছেন। তারা আবার এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, গার্ড অব অনার রাতে না দিয়ে দিনে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। জানি না, পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে মৃতদেহ অত্যন্ত শীতল মর্গে বা সরকারি ব্যয়ে রাখার সুপারিশও করেছেন কিনা।
এই নিবন্ধে মূল আলোচ্য বিষয় হলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পরে গার্ড অব অনার মহিলা ইউএনওদের নেতৃত্বে যেন না দেয়া হয়। কারণ মহিলারা কোনো মৃত দেহের জানাজা পড়াতে পারেন না। এই বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ধর্মের সুড়সুড়ি ছাপানোর জন্য? এরা কি বস্তুতই সংবিধান পড়ে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার করে শপথ নিয়েছিলেন?
এক. গার্ড অব অনার ও জানাজা কি এক?
দুই. রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী কোথাও গেলে যে গার্ড অব অনার দেয়া হয়, তাতে কি কোনো নারী-পুরুষ বাছবিচার করা হয় বা তেমন কোনো সিদ্ধান্ত কি সরকারের আছে?
তিন. এই সুপারিশের দ্বারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা অত্যন্ত স্পষ্ট। ১৯৭১-এ যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা কি আদৌ বিবেচনা করেছিলেন কোন মুক্তিযোদ্ধা হিন্দু বা কে মুসলমান বা কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান? মৃত্যুর পরে শুধু মুসলমানদের জানাজা পড়া হয়, কিন্তু বাকিদের? তাহলে অমুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু ঘটলে মহিলা ইউএনওরা গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব দিতে পারবেন, কিন্তু মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তারা নেতৃত্ব দিতে পারবেন নাÑ এমন একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা কি কোনো সভ্য দেশের সরকার কল্পনা করতে পারে?
চার. নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো প্রকার বৈষম্য করা যাবে না। এটা আমাদের পবিত্র সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালে নারী-পুরুষ-হিন্দু-মুসলমান একত্রে অস্ত্র হাতে লড়াই করে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গঠন করা করেছিল। বয়সের ভারে ন্যুব্জ নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু সংখ্যক সন্তান আজ ইউএনও, এডিসি, ডিসি, এমপি; যা মন্ত্রীদের পদে অধিষ্ঠিত। তাদের কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা বা অমর্যাদা প্রদর্শন জাতি কখনো মেনে নেবে কি?
পাঁচ. নারীর অধিকার হরণ বা নারী-পুরুষে বৈষম্য সৃষ্টির এই সুপারিশ আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর হাতেই মানায়।
ছয়. এই সুপারিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম ২০০৫ সালে ঢাকায় সমাবেশ থেকে যে ১৩ দফা প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাব উত্থাপন করে সরকারের গৃহীত নারী নীতি বাতিলের আওয়াজ তুলেছিল এবং নারীর জন্য বহিঃদুনিয়া জায়েজ নয়, তারা প্রাইমারির পরে আর লেখাপড়া করবে না ইত্যাদি বলে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, নারীর দায়িত্ব ঘরে আবদ্ধ থেকে রান্নাবান্না করা, সন্তান উৎপাদন ও তাদের দেখাশোনা করা এবং স্বামীর পরিচর্যা করা। আজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির কণ্ঠেও যেন হেফাজতে ইসলামে তৎকালীন আমির আল্লামা শফীর কণ্ঠস্বরই ধ্বনিত হলো।
সাত. শুধু তা-ই নয়, একদিকে ওই কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করেছে, একই সঙ্গে তারা দেশকে পুনরায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
আট. মহান নারীনেত্রী বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামালসহ যে মহীয়সী নারীরা নারী জাগরণ ঘটিয়ে নারী সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির কাজে সফলভাবে হাত দিয়েছিলেনÑ সংসদীয় কমিটির নারী ইউএনও সংক্রান্ত সুপারিশ তাকে শত বছর পিছিয়ে দিতে প্রয়াস পেয়েছে।
নয়. আজ আমরা নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পিকার, নারী মন্ত্রী, নারী এমপি, নারী সচিব, নারী জেলা প্রশাসক, নারী পুলিশ সুপার, নারী ইউএনও, নারী ওসি প্রভৃতি ছাড়াও নারী বিচারক, নারী আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি প্রভৃতি গড়ে ওঠায় বিশে^ যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিÑ এই সুপারিশ নিশ্চিতভাবেই সেই মর্যাদায় আঘাত হানবে। তাই জনগণের সুপারিশ হলোÑ
১. সংসদীয় কমিটির ওই সুপারিশ সরাসরি বাতিল ঘোষণা করা হোক;
২. সব সংসদীয় কমিটিতে অর্ধেক সংখ্যক নারী সদস্য যুক্ত করে সংসদীয় কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হোক;
৩. মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বর্তমান সংসদীয় কমিটির সদস্যদের সংসদ সদস্য পদ থেকে সংবিধান অবমাননার দায়ে বাতিল করা হোক;
৪. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানবিরোধী সুপারিশ করার দায়ে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হোক এবং
৫. সব সরকারি বিশেষ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে অর্ধেক নারী নিয়োগ করা হোক।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।
রণেশ মৈত্র : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।