শামসুদ্দিন আহমেদ পেয়ারা
আমাদের কাছে দেশভাগ মানে ভারত ভাগ হওয়া নয়। পাঞ্জাব ভেঙে কয় টুকরা হলো, কোন অংশ ভারতে আর কোন অংশ পাকিস্তানে পড়ল, সিন্ধুর ও রাজস্থান গোটা ছিল কি টুকরো হয়েছিল, কাশ্মীরের কয়টা জেলা পাকিস্তানে আর কয় জেলা হিন্দুস্তানের দখলে- এ নিয়ে বাঙালির কোনোদিন মাথা ব্যথা ছিল না।
আমাদের কাছে দেশভাগ মানে বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়া। আমরা হিন্দু-মুসলমানে পাড়াপাড়ি মারামারি অনেক করেছি; কিন্তু নিজেদেরকে কখনো দুই জাতি হিসেবে ভাবিনি। আমরা ছিলাম হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে একটা জাতি; বাঙালি জাতি। হিন্দুরা পুজা করেছে, মুসলমানরা নামাজ পড়েছে, বৌদ্ধরা ত্রিপিটক থেকে মন্ত্রোচ্চারণ করেছে, হিন্দুরা গীতা থেকে পূণ্য শ্লোক আউড়েছে, মুসলমান কুরআন থেকে সুর করে সূরা-কেরাত পাঠ করেছে।
হিন্দু পাঁঠা বলি দিয়েছে, মুসলমান গরু জবাই করেছে। হিন্দুর কোঁচা ও মুসলমানের কাছা, হিন্দুর টিকি ও মুসলমানের টুপি, সাধুর হাতে জপমালা ও হুজুরের হাতে তসবি- কারও সঙ্গে কারও টক্কর বাঁধেনি। তৃষ্ণার্ত হিন্দু ঘটি থেকে জল পান করেছে, পিপাসার্ত মুসলমান সোরাহি থেকে পানি গড়িয়ে খেয়েছে। একসঙ্গে মিলে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা করেছে, পয়লা বৈশাখে হালখাতা করেছে, কার্তিকে নবান্ন করেছে।
কোজাগরি রাতে চপল কিশোর গোপনে তার কিশোরীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। হিন্দুর মেয়ে নিয়ে মুসলমানের ছেলে ভেগেছে। মুসলমানের মেয়ে নিয়ে হিন্দুর ছেলে ভেগেছে। এই তো! কিছুদিন খুব হৈচৈ, তারপর সব স্বাভাবিক। এই ছিল আবহমান বাঙলার চালচিত্র।
‘হিন্দুর বাড়িতে যাত্রাগান হইতো
নিমন্ত্রণ করিতো আমরা যাইতাম।
.........
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’
সেই সুন্দর দিন আর থাকলো না। এক বাঙালি দুই হয়ে গেল কূটরাজনীতি আর উগ্রসাম্প্রদায়িক শক্তির মল্ল যুদ্ধে। দাঙ্গার আগুনে সোনার বাংলা পুড়ে ছাই হয়ে গেল ১৯৪৬ সালে। তার সঙ্গে শেষ হয়ে গেল স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও।
১৯৪৭ আমাদের পরস্পরের মধ্যে সীমানা টেনে আলাদা করে দিলো। ছিলাম বাংলা, হয়ে গেলাম ভারত ও পাকিস্তান। ছিলাম বাঙালি; হয়ে গেলাম বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান।
বাংলা ভাগ বাঙালিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারতে সে হারিয়ে গেছে বিশাল ভারতীয় হিন্দি সুনামিতে। বাংলাদেশে সে তার অস্তিত্ব খুইয়ে ধর্মান্ধতা, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতি, স্বৈরাচার ও কূপমণ্ডকতার কাদাজলে গড়াগড়ি দিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার বোকা আনন্দে নিজের চারপাশে নিজে চক্রাকারে ঘুরে মরছে।
বাঙালিকে ফের নিজের পায়ে ভর করে উঠে দাঁড়াতে হবে। ভাঙা বাংলাকে জোড়া দেবার দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই। এপারের এবং ওপারের; দু'পারের বাঙালিকে।
এ নিয়ে একটা জাতীয় বিতর্ক শুরু করা যেতে পারে। বিষয় দেয়া যেতে পারে- স্বাধীন বৃহৎবঙ্গই বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষা, পুনরুত্থান ও বিকাশের একমাত্র ভিত্তি ভূমি ও বাঙালির প্রতিভা স্ফূরণের আদর্শ স্বর্গোদ্যান।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
সান নিউজ/এমএইচ