ফজলুল বারী
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে হেঁটে দেশের সাংবাদিকতাসহ নানাকিছু পোড় খাওয়া নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। কবি, আবৃত্তিকার, অভিনয় নির্মাতাদের সংগঠনও তখন গড়ে উঠেছে। ওই সময় যেসব পোড়খাওয়া সাংবাদিক সৃষ্টি হয়েছেন তাদের একজন সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, '৬০ আর ৭০-এর ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা হলে কি দারুণ লাগে।
তারা দৃপ্ত, তারা সেক্যুলার, তারা প্রজ্ঞায় অতুলনীয়। কি অসাধারণ বিশ্লেষণ করেন ঘটনাবহুল সময়ের! আর এখনকার সদ্য বিদায়ী ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন যে লাগে…। রাজনৈতিক আলোচনায় কেবল বিষোদগার তাদের সাথীদের বিরুদ্ধে...রাজনৈতিক বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকট। আর দর্শনের জায়গায় খালি সংশয়।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা অনেক কারণ বিস্তারিতভাবে লিখতে যাননি। আমি কিছুটা লিখি, এর শুরুটা কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃ্ত্বের হাতে। আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদের মতো নেতাদের সাইজ করতে এক সময় দৃশ্যপটে আমির হোসেন আমুকে আনা হয়। এরপর ওবায়দুল কাদেরকে। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রত্যাশীরাও ছাত্রদের কাছে যাওয়া বাদ দিয়ে এসব নেতাদের বাড়িতে-বৈঠকখানায় যাতায়াত-সময় দেয়া বাড়িয়ে দেন। কেউ কেউ তাদের বাজারের থলেও টানতেন।
এরপর ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন বত্রিশ নাম্বারের বাসিন্দা কয়েকজন। ছাত্রলীগ দিনে দিনে এর সংগ্রামী চরিত্র হারায়। এখন ছাত্রলীগের খুব কম সংখ্যক নেতাকর্মী সংগঠনটির ইতিহাস-নীতি-আদর্শ কর্মসূচি ভালো করে জানে। এখন আর এসব জানাও লাগে না। শুধু কিছু শ্লোগান জানলে দিতে পারলেই চলে, 'শ্লোগান আছে...কোন সে শ্লোগান...ব্যাস! পোশাকে চেহারায় আগে ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েদের আলাদা চেনা যেত। এখন কোনটা ছাত্রলীগের কোনটা ছাত্রদল বা শিবির চটজলদি আলাদা করা কঠিন।
বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ শিখবে পরে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথায় কথায় 'আলহামদুলিল্লাহ-জাজাকাল্লাহ খাইরানে' ভরপুর এই ছাত্রলীগ। এর জন্য এরা অবলীলায় হেফাজতের ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীর পক্ষ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তৃতাও দেন। অথবা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা হাবিবুর রহমান বিএনপি নেতাও বনে যান! যে ছাত্রলীগের ছেলেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে, সেই ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ নয়। বঙ্গবন্ধু এই ছাত্রলীগ গড়েননি বা এই ছাত্রলীগের স্বপ্ন দেখেননি।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে এটা কেউ বলতে পারবে না।
আমরা যখন সাংবাদিকতায় এসেছি ছাত্রলীগের ছেলেরা-মেয়েরা আমাদের এতটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ছিলো যে কোনো মিছিলসহ নানান প্রস্তুতি-এক্সক্লুসিভ আমরা আগে-ভাগে পেতাম। অনেক সময় আমরা পৌঁছবার পর কর্মসূচি শুরু হতো বা লাইন বাই লাইন নির্ভুল তথ্য আমাদের জন্য রেডি থাকতো। সেই সময়ের সাংবাদিকতাও এখন আর নেই। এখন যেন একদল আরেক দলের প্রতিপক্ষ!
২০১৬ সালে দেশে গিয়ে একটা ঘটনায় চমকে যাই। আমাকে একটি ছেলে সময় দিচ্ছিলো। ঢাকায় সে তার আত্মীয়ের বাসায় থেকে ছাত্রলীগের ঢাকার কোন একটি কমিটিতে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। এজন্য সে রুটিন করে প্রতিদিন অমুক অমুক নেতার বাসায় যাতায়াত করতো। কোথায় পড়ে কখন পড়ে তা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
একজনের জন্য কিছু কাপড় কিনতে আমাকে নিউমার্কেট এলাকার একটি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ডেকে আনা হয়েছে ঢাকা কলেজের একজনকে। দাম দেবার সময় ভীতসন্ত্রস্ত দোকানি আমাকে বলছিলেন, 'উনাকে যখন নিয়ে এসেছেন তখন কত আর দেবেন, এই দেন'।
খুব বিব্রত লেগেছে ঘটনাটি। নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। আমার তখন টাকার সমস্যাও ছিলো না। এই ছাত্রলীগকে আমরা চিনতাম না। এই ছাত্রলীগ একদিনে একা একা এই চেহারায় আসেনি। কিন্তু দোষটা শুধু ছাত্রলীগেরই হচ্ছে।
লেখক: ফজলুল বারী
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
সান নিউজ/এমএইচ