শামীম আজাদ
চল্লিশ বছর আগের কথা। আমার শরীর ভাল না, ধানমন্ডির বাসা থেকে মা’র কাছে সোবহান বাগ সরকারি কলোনীর ফ্ল্যাটে থাকতে এসেছি। মাথা তুলতে পারি না। গা গুলায়। মনে হয় তখন সজীব এসে গেছে পেটে। আম্মা কতকিছু করে আনেন- খেতে পারছি না। মুখে একদম স্বাদ নেই। তবু এখানে আমাদের বাবুর্চি দরবেশ আলীর রান্নার চেয়ে ভাল খাই।
সেদিন ভাতের সঙ্গে খেতে দিয়ে গেছেন রসুন ও শুকনো লাল মরিচে ফোঁড়ন দিয়ে কার্নিশের বাগান থেকে তুলে আনা কচি লাল শাক, আস্ত আস্ত রসুন কোয়া ও জলপাই দিয়ে উত্তম সুগন্ধী ডাল ও সর্ষে বাটা দিয়ে পটলের খোসার ভর্তা। আমার বিছানার পাশেই। বিয়ের আগে আমি যে ঘরে থাকতাম সেই সেকেন্ড বেডরুমে। আমি কিছু ভাত মাখি আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আম্মার শত কাজ। তারমধ্যে এসে দেখেন এখনো খাওয়া শেষ করিনি।
ওপরে ফ্যান ঘুরছে। আমি বাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ভক্সওয়াগনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্লেটের ভাত মাখছি আর মাখছি। ঠিক তখনি মায়ের গন্ধ পেলাম। তাকিয়ে দেখি তিনি পেছনে। বেগুনী শাড়িটি নরমভাবে তাঁকে পেঁচিয়ে ধরেছে। দু’একটা জায়গায় মশলার ছোপ। উঁচু করে বাঁধা চুলের নিচে ঘাড়ের কাছে ঘামের বুদবুদ। মুখখানা জামরুলের মুখের মত লাল। রান্নার গন্ধ ও মায়ের মাথার তেলের সুগন্ধ মিলে কিছু একটা সে বাতাসে ভাসছে। আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে টান মেরে প্লেট টা নিয়ে নিলেন। তারপর তা সামনের বর্গ ক্ষেত্র মাথা কাঠের পুরানো টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। মানে তিনি নিজেই আমাকে মেখে খাওয়াবেন। হাত ধুতে বাথরুমে যেতে যেতে বল্লেন, তোর জিব্বাত যুদিরে ফুত এখটা প্লাস্টিক লাগাইন যাইতো! তে আর সমস্যা আছিল না।
কেনে আম্মা? মুকো মজা লাগার দরকারই অইলো না নে। আমি হেসে উঠতেই তিনি আরো বললেন এ শুধু আমার জন্য না পুরো মানব জাতির জন্য তা উপযোগী হতো। কেন? মাইনষে তখন সব সময় রাইক্কসোর লাখান অত খাই খাই করলো না নেরে মা। আর খাইয়া খাইয়া গারে গর্দানে আত্তি বনলো না নে।।
হাত ধুয়ে ফিরে এসে কি করে সেই একই বস্তুগুলো দিয়েই কি মাখলেন কে জানে, আমার স্বাদ লাগতে লাগলো। আমি পাখির বাচ্চার মত হা করে করে একটা একটা লোকমা নিতে লাগলাম। ঈশিতা খেলা রেখে অবাক চোখে দেখে গেলো। আমরা এবার জিব্বায় প্লাস্টিক লাগানোর কথায় ফিরে যাই।
তিনি দারুন কৌতুক দিপ্ত কন্ঠে বুঝিয়ে বললেন, পাওতলা কোন প্লাস্টিক দিয়ে জিহবা ঢেকে যদি খাওয়ার প্রক্রিয়া করা যেতো তাহলে মানুষ শুধু বাঁচার জন্যই ওষুধের মত খাবার খেতো। এতে কাজ বেশি করতো। এ ছাড়াও মানুষ কত কিছু নতুন খেতে পারতো। এই যেমন ঘাস, কাঁচা সালাদ, লতা, পাতা, গাছের বাকল, খেয়ে পুষ্টি পেতে পারতো! আমি লোকমা নিই আর হাসি। শেষে মা ও মেয়ে মিলে লিস্ট করেছিলাম মানুষের আর কী কী খেতে পারার কথা। এবং তা পশু হত্যা না করেই।
তখনো আনোয়ারা তরফদারের রান্নার বই ‘খাদ্যবিলাস’ আমার বন্ধু ও কবি আবিদ আজাদের 'শিল্পতরু' থেকে বেরোয়নি। আব্বা তখনো বেঁচে আছেন। সবাইকে সেবা করে, জামা বানিয়ে, গল্পবই পড়েই তার যায় সময়। কোনদিন যে তিনি রান্নার বই লিখবেন ভাবেন নি। আমি তখন মহা জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রার সাংবাদিক। ম্যাগাজিনের পেছনের চার পাতা -‘জীবন এখন যেমন’ বিভাগের সম্পাদক। সেখানে কী না আছে। পকেট আঈন, কী করবেন, কোথায় পাবেন, ফ্যাশন, কুরুক্ষেত্র ও খাদ্যবিলাস।
খাবারের ভাবনায় আমি কিন্তু লক্ষ্য করতাম আম্মা রান্নাঘরে প্রবেশ করলেই কী একটা ম্যাজিক হয়ে যায়! তখন তাঁকে দিয়ে লেখাতে শুরু করি। মনে আছে শুরুতে ভীষণ লজ্জা পেতেন। বলতেন তিনি তাঁর বানান নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। আমি বলতাম, সে তো আমি ছাড়া আর কেউ দেখবেই না। তিনি লিখতেন সাধু ভাষায়- আমি সম্পাদনা করে তা কথ্য করে দিতাম, আর কত যে নতুন রান্না ছাপতাম। অচিরেই জনপ্রিয়তার জন্য তার প্রমোশন হলো ঈদের রান্নায়। তখন শাহাদত ভাই, সেলিনা, মাসুক, শিবলী আম্মার ছাপা হওয়া রান্না খেতে আসতেন ।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তিনি কোন কিছুরই খোসা ফেলতেন না। তা দিয়ে হয় ভর্তা নয় স্টক। স্টক দিয়ে হয় স্যূপ না হয় তা ব্যবহার করতেন তরকারী বা মাংস রান্নার ঝোল করার জন্য গরম জলের বিকল্পে। আমরা ছোট বেলা গরমের ছুটিতে গ্রামে গেলে দেখেছি ঝোঁপ ঝাড় থেকে সংগ্রহ করাতেন বতুয়া, থানকুনি, বুনো কচু, কাঁটা ডাঁটা ও শেয়াল্মুর্তি শাক। তাতে আব্বার আগ্রহেরও কমতি ছিলো না।
শহরে কদাচিৎ বিশেষ কেউ কেউ মাথায় করে নিয়ে আসতো ঢেঁকি শাক। আম্মা সেই কুক্রে মুক্রে ঘাড় গোঁজ করে থাকা সবুজ শাকের সঙ্গে টেলে ভিজিয়ে রাখা সীম বিচি দিয়ে যখন রান্না করতেন তখন আমাদের পড়ার ঘরে ভেসে অসাধারন এক স্বাদু গন্ধ। স্কুলে যাবার আগে যেদিন এক চামুচ ঘি’তে গরম ভাত দিয়ে সে সব মিহি করে কাটা শাক দিতেন আম্মা মনে হত এর জুড়ি নেই। লাফাতে লাফাতে স্কুলে যেতাম।
কলমি, শাপলা, হেলেঞ্চা তখনো ভদ্রলোকের ডাইনিং টেবিলে উঠেনি। জানতামই না ওরা কোথায় জন্মে- মাটিতে না জলে।
নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাসার পাশেই ছিলো কেশব বাবুর পুকুর। আম্মার কথায় একদিন মনা ভাই পিতলের কলসী ভাসিয়ে ভাসিয়ে সাঁতার কেটে কেটেই কি অপূর্ব কৌশলে তুলে আনলেন হেলেঞ্চা, কলমি আর শাপলা। কাঠের চুলোয় সে সব রান্নার আগে আম্মা তা যখন কুটতে বসলেন সেটাই এক দেখার বিষয়। মহার্ঘ ঐ শাক লতা পাতার শৈল্পিক বিভাজন আমি পড়া রেখে দেখতাম।
আব্বা ইজিচেয়ারে জলের হুকোতে টান মেরে মেরে দেখতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, আনোয়ারা ইটার লগে হুকইন দিবায়, ওটাত মাছোর ডিম! আমি শাপলার আঁশে লেগে থাকা ফুলের মালা বানাতাম, পোক্ত ফুলের গুটা থেকে ভেঙে মাছের ডিমের মত বিচি কী করে বের করতে হয় তা দেখাতেন আব্বা। শাপলার নরম লতা বা কচুর ডাঁটা দিয়ে ইলিশের মাথা ভেঙে, সর্ষের তেলে ঘুঁটে রান্না করতেন আম্মা।
নামাবার আগেই দিতেন তাজা ধনে পাতা। আরো কত শাকের কথা মনে পড়ছে! করলা,পাট, লাউর কচি পাতা- মেস্টা এর সবগুলোই বেশ করে বেরেস্তা করে তাতে বাগার দিয়ে হত সুন্দর শাক রান্না। লাল মুরগীর ঝুটির মত মেস্টাগুটার খোসাতে বানাতেন তিনি অপূর্ব জেলি আর জ্যাম। আর তার টক টক পাতা বেটে কখনো ভর্তা, কখনো কুচো চিংড়ি দিয়ে লম্বা ঝোলের টক-যাকে আমরা সিলেটিরা বলি টেঙ্গা। আম্মার টেঙ্গার ছিলো নানান রকম।
কচুর পাতা সেদ্ধ করে বেটে দিয়ে তাতে গুলে দিতেন তেতুল ও এক চিমটি চিনি। ঐ তেঁতুলের জন্য কচুতে গলা ধরতো না। মাঝে মাঝে তাতে দিতেন বাটা তিল। ভাত খাওয়ার সময় শেষ আইটেম ছিলো টেঙ্গা। অল্প ভাত ডলে কাবু করে তার ওপর ঢলঢলা করে সবুজ টক নিতাম। প্লেটে দেখা যেতো টেঙ্গা মাখা ভাতের ওপর চিকচিক করে ভাসছে তিসি বা তিলের খোসা।
আজকাল ওজন কমানোর চেষ্টায় খাদ্য সংকোচ করতে গেলেই আম্মার কথা মনে হয়। মনে হয় জিহ্বায় প্লাস্টিক ফিট করার কথা। আহা তাই যদি করা যেতো!
লেখক—কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিক্ষক
সান নিউজ/এনএম