এম এম রুহুল আমিন:
কালে কালে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে মহামারি। বদলে দিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে নগরায়ণ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও যুদ্ধ মহামারির বিকাশ ও বিস্তৃতিতে অনুঘটকের কাজ করেছে। ঘটিয়েছে মানুষের জীবনের ঐতিহাসিক পরিবর্তন।
মহামারি বা অতিমারির ইতিহাস অতি প্রাচীন। মানুষ যখন শিকার ও খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করত তখনও পৃথিবীতে সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারি ছিল। তবে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস না করার ফলে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে পারত না। এখন থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মানুষ যখন সমাজবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে তখন থেকেই মূলত: সংক্রামক ব্যাধি মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করে। ম্যালেরিয়া, প্লেগ, কুষ্ঠ, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, গুটি-বসন্ত বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে।
খৃস্ট পূর্ব ৩০০০ সালে প্রাচীন চীনের উত্তর-পূর্ব দিকে হামিন মাঙ্গা ও মিয়াওজিগো অঞ্চলে সিরকা নামক মহামারির উল্লেখ পাওয়া যায়। চীনের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষণায় এ মহামারির বিষয় জানা যায়।
খৃস্ট পূর্ব ৪৩০ সালে পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময় লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর ও এথেন্সে টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। এ রোগের উপসর্গ ছিল জ্বর, পিপাসা, গলা-মুখ থেকে রক্ত নির্গত ও শরীর লাল হওয়া। এ রোগকে এথেন্সের প্লেগ বলা হয়। এ প্লেগ রোগে উক্ত অঞ্চলের প্রায় ২ তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়।
১৬৫ খৃষ্টাব্দে প্রাচীন চীনা বংশোদ্ভূত দুর্ধর্ষ হান্স অশ্বারোহী সেনাদলের মধ্যে গুটি বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকাশ পায়। জ্বর, গলাব্যাথা ও ডাইরিয়ার লক্ষণ সম্বলিত রোগটিকে তখন আনটোনিন প্লেগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। হান্স অশ্বারোহী সেনাদলের মাধ্যমে রোগটি জার্মানদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পুরো রোমান সাম্রাজ্যে মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করে। প্রায় ১৫ বছর পর রোগটির প্রকোপ কমতে থাকে। রোগটি রোমান সাম্রাজ্যের ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। সম্রাট মার্কোস এ রোগে মারা যান বলে দাবী করা হয়।
২৫০ খৃস্টাব্দে সিপরিয়ান প্লেগ নামে ইউরোপে আরেকটি রোগের আবির্ভাব হতে দেখা যায়। কার্থেজের খৃস্টান ধর্মযাজক সেন্ট সিপরিয়ান আক্রান্ত হওয়ায় তার নাম অনুসারে এ রোগের নাম প্রথম প্রকাশ পায়। রোগটি ডায়রিয়া, গলায় ঘাঁ, জ্বর এবং হাত-পায়ে গ্যাংগ্রীন সৃষ্টি করে। এ রোগের ভয়ে নগরবাসী গ্রামে পালিয়ে যায় আর এর ফলেই রোগটি সারা দেশেই মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। রোগটি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, তা ইথিওপিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা, রোম, মিশর এবং সমগ্র উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ব্রিটেনে আঘাত হানে। এ সময় স্কট ও পিক্টসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ব্রিটেনের আদিবাসীরা মারাত্মক প্রতিরক্ষা হুমকিতে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারা স্যাক্সন জাতির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে কিনত স্যাক্সনরা সুযোগ বুঝে পুরো অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
৫৪১ খৃস্টাব্দে জাস্টিনিয়ান প্লেগ নামের মহামারি রোগের প্রকাশ পায়। রোগটি মিশর থেকে উৎপত্তি হয়ে প্যালেস্টাইন ও গ্রীক সাম্রাজ্য হয়ে ভূমধ্য-সাগরীয় অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। রোগটি রোমান সাম্রাজ্যের প্রসারের গতি কমিয়ে দেয় এবং ব্যাপকভাবে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দেয়। অলৌকিকভাবে এ মহামারি খৃস্টান ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। মহামারিটি পরবর্তী ২০০ বছর বিভিন্ন সময়ে ঘুরে ফিরে আসে এবং পৃথিবীর প্রায় ৫০ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষ এ রোগে মারা যায়। ধারণা করা হয় যে, ইঁদুর ও মাছি থেকে সৃষ্ট শরীরের গ্রন্থি ফুলে যাবার লক্ষণ সম্বলিত রোগটি পরবর্তীতে বুবনিক প্লেগ হিসেবে পরিচিতি পায়। রোগটি ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে বেশী আঘাত আনে। ফলে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
১৩৪৬ খৃস্টাব্দে ব্লাক ডেথ নামে একটি মহামারি এশিয়ার সিল্ক রোড ও উত্তর আফ্রিকা হয়ে পুরো ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। ধারনা করা হয় যে, এ রোগে ইউরোপের অর্ধেক মানুষ মারা যায়। জনগোষ্ঠীর এত বড় ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পরবর্তী ২০০ বছর ইউরোপকে অপেক্ষা করতে হয়।
১৫৪৫ খৃষ্টাব্দে টাইফয়েড ও জ্বরের উপসর্গ নিয়ে cocoliztli কোকোলিজটলি নামের এক ধরনের মহামারি দেখা দেয়। এ রোগে মেক্সিকো ও আমেরিকার প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
১৬০০ খৃষ্টাব্দে ইউরোপ থেকে গুটিবসন্ত রোগের উপসর্গ নিয়ে আমেরিকায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ রোগের ফলে ইনকা ও এজটেক সভ্যতা বিলীন হয়ে যায়। ধারনা করা হয় যে এ রোগের কারণে পশ্চিম গোলার্ধের ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী মারা যায়।
১৬৩০ খৃষ্টাব্দে ইতালিতে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ রোগে ইতালির ২৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। জার্মান ও ফরাসী সেনাবাহিনীর সাথে ৩০ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের সময় প্রথমে মিলানে রোগটি বিস্তার লাভ করে।
১৬৬৫ খৃষ্টাব্দে কুখ্যাত লন্ডন প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সমগ্র ব্রিটেনে এ ব্লাক ডেথ এতটাই মহামারি আকার ধারণ করে যে, লন্ডনের ১৫ শতাংশ নাগরিকসহ প্রায় ১ লাখ মানুষ এ রোগে মারা যায়।
১৭২০ খৃষ্টাব্দে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী জাহাজের মাধ্যমে মার্সেইল প্লেগ রোগের উৎপত্তি ঘটে। যদিও জাহাজখানা কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল, তবুও আক্রান্ত ইঁদুর ও মাছির মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে এবং বলা হয়ে থাকে যে, এ রোগে মার্সেইল জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ মানুষসহ প্রায় ১ লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
১৭৭০ খৃষ্টাব্দের রাশিয়ান প্লেগ, ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দের ফিলাডেলফিয়ার ইয়োলো জ্বর, ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের ফ্লু এবং ১৯১৬ সালের আমেরিকান পোলিও মহামারি আকারে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
১৮২০ সালে কলেরা রোগের আবির্ভাব ঘটে। রোগটি প্রথমে থাইল্যান্ডে প্রকাশ পায়। এরপর ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন্স হয়ে পুরো এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কোলকাতা থেকে কলেরাটি ছড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা এবং ভূ-মধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। হজ্ব-যাত্রীদের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া এশিয়ান কলেরা নামের এ রোগটি মক্কার যাত্রাপথে স্থানান্তরিত হয়েছিল। মূলত: নদীর পানি পান করার ফলে সংক্রমিত এ রোগটি ১ লাখের বেশী মানুষ মারা যায়।
১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে সমগ্র ভারতবর্ষ ও চীনে তৃতীয় পর্যায়ের প্লেগ রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। রোগটিকে বুবনিক প্লেগ নামে অবিহিত করা হয় এবং এ রোগে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
১৯১৮ সাল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দেয়। বলা হয়ে থাকে যে, রোগটিতে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ বা ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৬৫৭,০০০ আমেরিকানসহ প্রায় ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মতান্তরে ১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। রোগটি ইউরোপে শুরু হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং এশিয়ার কিছু অংশে বিস্তার লাভ করার পর সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগের কোন প্রতিষেধক না থাকায় মানুষজনকে মাস্ক ব্যবহার করা, স্কুল, থিয়েটার বা ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ রাখতে হয়। স্পেন থেকে প্রথমে এ মহামারির সংবাদ প্রচারিত হয় বলে এ রোগের নাম দেয়া হয় স্প্যানিশ ফ্লু।
১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লু নামে চায়না থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে। রোগটি সিংগাপুর, হংকং হয়ে আমেরিকার উপকূলবর্তী শহর সমূহে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে আমেরিকার ১১৬,০০০ সহ বিশ্বের ১১ লাখ মানুষ মারা যায়।
১৯৮১ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় শিম্পাঞ্জির মাধ্যমে (১৯২০)মানুষের মধ্যে এইচআইবি এইডস ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। রোগটি শনাক্ত হবার পর এ পর্যন্ত ৩৫ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বলা বাহুল্য প্রায় শতবর্ষ ধরে চলমান এ রোগের পূর্ণ প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলেও ১৯৯০ সালে আবিষ্কৃত চিকিৎসার মাধ্যমে অদ্যাবধি প্রায় ৪০ মিলিয়ন আক্রান্ত মানুষ জীবনযাপন করে চলেছে। তবে আশার বিষয় হলো এবছরই এইচআইবি এইডস মহামারি থেকে ২ জন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
২০০৯ সালে মেক্সিকো থেকে সৃষ্ট সোয়াইন ফ্লু মহামারি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১.৪ বিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে কতজন মানুষ মারা যায় তার সঠিক হিসাব এখনও অজানা। সিডিসির তথ্যমতে ২ লাখ থেকে প্রায় ৬ লাখ মানুষ এ রোগে মারা যায়। বর্তমানে এ রোগের টীকা আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গায়নায় প্রথম ইবোলা মহামারি শনাক্ত হয়। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিয়নে এ রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। অধিকন্তু নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল, আমেরিকা ও ইউরোপেও রোগটি সামান্য পরিমাণ ছড়ায়। ইবোলার কারণে ২৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১১ হাজার মানুষ মারা যায়।
২০১৯ সালে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান অঞ্চলে নভেম্বর মাসে প্রথম করোনাভাইরাস মহামারির আবির্ভাব ঘটে। জ্বর, কফ ও শ্বাসকষ্টের মত উপসর্গ নিয়ে ২ শতাধিক দেশে বৈশ্বিক এই মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের পরে ইরান, ইতালি, স্পেনসহ সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকায় প্রতিনিয়ত রোগটি প্রতি মূহুর্তে জ্যামিতি-কহারে বিস্তার লাভ করে চলেছে।আর সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
মহামারি বা অতিমারির বিচারে প্রাচীন কাল থেকেই অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ বা অঞ্চলে বিশেষত: ইউরোপ আমেরিকায় প্রাণহানি বেশী। সবশেষে বলা যায় যে বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে কত অসহায় আমরা। আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সত্য মানুষ যা কিছুই করুক না কেন নাটাই কিন্তু প্রকৃতির হাতেই। (তথ্যসূত্র: অর্ন্তজাল)
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাব