এম এম রুহুল আমিন:
চীনের উহানে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের মাস খানেকের মধ্যেই চীন এলাকাটি পুরোপুরিভাবে লকডাউন করে দেয়। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে লকডাউন সফল করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে দেখা যায়। প্রথম দিকে চীনের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এহেন পদক্ষেপে বিশ্বব্যাপী কমবেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ সমালোচনার দিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে। ফলে স্বল্প সময়ে তার সুফল হিসাবে দেশের অন্য জায়গায় এর বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
দেশটিতে এখন সংক্রমণ যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে উহানের মৃত্যুর হার। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ উহানের অভিজ্ঞতা নিজ নিজ দেশে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। বলা বাহুল্য যেসব দেশ যতটা কঠোরভাবে চীনের উহানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে তারা ততটাই সুফল পেয়েছে। একইভাবে যেসব দেশ চীনের অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা - অবহেলা করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং করোনায় ভুগছে।
দেখা যায় যে, ইতালিতে কর্তৃপক্ষ চীনের অভিজ্ঞতার আলোকে জনসাধারণকে সতর্ক করলেও স্বাধীনচেতা ইতালীয়রা তা আমলে নিতে ব্যর্থ হয়। এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদেরকেও আইন প্রয়োগকারীদের সাথে প্রথমদিকে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ফলে এক সময় ইতালির মৃত্যুর মিছিল চীনকেও ছাড়িয়ে গিয়ে সমগ্র ইউরোপে বিস্তৃত করে। বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের আইন অমান্য করার ফলে একটি জাতি যে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে, ইতালি তা এখন মোকাবেলা করছে। পুরো রাষ্ট্র যন্ত্র এখন দিশেহারা হয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
চীন ও ইতালির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ও সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়নে স্পেন তার নাগরিকদের উপর চড়াও হতে একটুও পিছপা হয়নি। ফলে স্পেন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে এখন অনেকখানি আশাবাদী।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমদিকে করোনাভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে উপহাস করতেও ছাড়েননি। এমনকি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টাদের লকডাউন পরামর্শকেও তিনি গুরুত্ব দেননি। অবশ্য এখন তিনি বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির বিপদ উপলব্ধি করে তাঁর বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। এখন তিনি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমেরিকান করোনাভাইরাসের ক্ষতির পরিসংখ্যান দিয়ে চলেছেন। ট্রাম্পের পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। কখন এবং কোন পরিমাণে গিয়ে এ পরিসংখ্যান থামবে তার কোন পরিসংখ্যান ট্রাম্প দিতে পারবেন বলে বিশ্বের কেউ তা আর বিশ্বাস করে বলে মনে হয়না। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা যথেষ্ট সময় পাবার পরেও চীনের অভিজ্ঞতার সুফল নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আর নির্মমভাবে ভুগতে যাচ্ছে বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা। যে দেশের সংবিধান তার দেশের একজন নাগরিকের নিরাপত্তা দিবার প্রশ্নে প্রয়োজনে অন্য কোন দেশের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা দেয়, সে দেশের অসংখ্য নাগরিকের মূল্যবান জীবনহানির এহেন অবহেলার নির্মম দায় কে নেবে ?
আজ ভারতও আক্রান্ত। ভারতীয় সরকার যথাসময়ে দেশকে লকডাউনে নিলেও জনসাধারণ এখনও পুরোপুরিভাবে করোনার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেনি। তবুও সরকারের প্রচেষ্টার কমতি আছে বলে মনে হয়না। সময়ই তার সফলতার চিত্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে বলে আশা করা যায়।
সবচেয়ে আশার আলো দেখিয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটি উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক ভাবে দেশজুড়ে লকডাউন করে দেয়। জনসাধারণও সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বতঃস্ফুর্তভাবে একাত্ম হয়ে এগিয়ে আসে। ফলে সেখানে জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ২জন নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। দেশ হিসাবেও সমগ্র এশিয়ায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার রয়েছে ঈর্ষণীয় সফলতা। শ্রীলঙ্কার এ সফলতার পেছনে রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ। ফলে একটি শিক্ষিত জাতি হিসাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তার কোন বেগই পেতে হয়নি।
বাংলাদেশও চীনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় পেয়েছে। তবে তার অবস্থাও কিছুটা ভারতের জনগণের মতোই বলতে হবে। জনসাধারণ এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা পুরোপুরি অনুধাবন করেনি এবং আমলে নিচ্ছে না । বাংলাদেশের সরকার প্রথম থেকেই জনসাধারণকে আতঙ্কিত না করে সজাগ করতে ধীর গতির নীতি অবলম্বন করে। এরই মধ্যে দেশের কিছু মেগা অনুষ্ঠান বাতিল করে এবং লকডাউন শব্দ ব্যবহার না করে দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনসাধারণকে ঘরে রাখতে সচেষ্ট আছে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক দিক হলো স্বল্পাহারের শিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ঘনবসতি সর্বোপরি ব্যাপকহারে হদিস বিহীন বিদেশ ফেরত ও শহর ফেরত নাগরিকের যত্রতত্র বিশৃঙ্খল ও বিপজ্জনক চলাফেরা । যা সরকারের সামাজিক দূরত্ব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রধান বাধা। অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে প্রশাসনের ”পাছে লোকে কিছু বলে” নামক দুর্বল ভূমিকাও সংক্রমণ রোধকে আরো হুমকির মুখে ফেলেছে।
করোনাকালের লকডাউনের কারণে কর্মহীন মানুষকে সাহায্য দেওয়ার নামে ডিসি,-ইউএনও ও রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দের বস্তা ঘাড়ে ফটোসেশনের ইউটিউবে ঘুরতে থাকা চিত্রগুলো সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করণকে যেমন হাস্যকর করে তুলেছে তেমনি সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে জনসাধারণকে নসিহত করার কাজও তামাশায় পরিণত করে ফেলেছে। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, উৎসুক জনতা রেডিমেড প্রশ্ন-উত্তর মাথায় সাজিয়ে রাস্তার তামাশা দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। এ জাতি তার ডান হাত বাম হাতের পরেও আরো একটি হাত ”অজুহাত” দেখাতে খুবই পরিপক্ক। পুলিশ, প্রশাসন বা সেনাবাহিনী কোন পথচারীকে বাইরে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেই তার কোন না কোন উত্তর দিতে কারো আর কোন দেরী হয়না।
সেনাবাহিনী দেশের জনসাধারণের কাছে একটি সর্বশেষ শক্তিশালী আশ্রয়ের স্থান। দেশের যে কোন ক্রান্তিকালে বা বিরূপ পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর উপস্থিতিই সবধরনের এলোমেলো পরিস্থিতিই শান্ত হয়ে যাবার নজীর রয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর বর্তমান উপস্থিতি করোনাকালের সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়নের পদক্ষেপকে হতাশ করেছে।
দেশের স্বার্থে স্পেনের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অমান্য বা অবহেলাকারী কোন নাগরিকের উপর যেখানে চড়াও হতে পিছপা হচ্ছেনা সেখানে করোনাকালের বিপদের দিনে বিশৃ্ংখল নাগরিকের সাথে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ আরো কঠিন হওয়া উচিত বলে মনে করি।
পুলিশ প্রশাসন আপামর জনসাধারণের স্বার্থে নিরলস এবং নিবিড়ভাবে কাজ করবে সত্য, তবে যখন দেশের সেনাবাহিনীর রাস্তায় নেমে আসার প্রয়োজন পড়বে তখন তা হবে দেশের স্বার্থে, নিছক জনস্বার্থে নয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনা এখন এমনই এক শক্তিশালী শত্রু, যাকে পরাজিত করতে তাই প্রয়োজন পড়েছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর। সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন উৎসুক জনতার তামাশা নয়। একে রুখতে হবে- রুখতে হবে করোনা সংক্রমণ। এ যুদ্ধে জয় আমাদের হতেই হবে ইনশাআল্লাহ্ ।
এম এম রুহুল আমিন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাব।