তানভীর রাসিব হাশেমী:
রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, টেম্পুওয়ালা অতঃপর এখন যোগ হয়েছে বাইকওয়ালা। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ আসার পর থেকে এখন সর্বত্র এই বাইকওয়ালাদের আনাগোনা। রাইড শেয়ারিং অ্যাপের ধারণাটি শুরুতে ‘শেয়ারিং’ হলেও এটাকে এখন অনেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কোনো একটি অ্যাপের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে তারা দিন-রাত মোটরসাইকেল বা গাড়ি দিয়ে যাত্রী পরিবহনের কাজ করছেন। তবে গণপরিবহনে ঝক্কি এড়াতে অ্যাপগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও ভাড়া বেশি, চালকদের দুর্ব্যবহারসহ নানান অভিযোগের শেষ নেই।
ইদানীং চালকদের অনেকে সুযোগ পেলে অ্যাপে না গিয়ে চুক্তিতে চলাচল করছেন। রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এখন সহজেই রাইড শেয়ারিং সেবা দেয়া মোটরসাইকেল বা গাড়ি বেশি চোখে পড়ে। সার্ক ফোয়ারা মোড়, ফার্মগেট, শাহবাগ, বনানীসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় এদের উপস্থিতি বেশি। সেখানে বাইক ওয়ালাদের মুখে ডাক শোনা যায়, ভাই কই যাবেন? জবাবে আগে থেকেই তারা বলেন, ‘অ্যাপে যামু না, এমনে চুক্তিতে যাইবেন?’ এভাবে অনুরোধ করা হয় অ্যাপ বন্ধ রেখে চুক্তিতে যাওয়ার জন্য। এতে ওই চালকের রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে ভাড়ার কোনো অংশ দিতে হয় না।
বেশ কয়েক মাস ধরেই এ ধরনের সুযোগ নিয়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের চালকেরা সেবা দিচ্ছেন। তবে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়ে এটা বেড়ে যায়। যানবাহনের সংকট থাকায় বেশি ভাড়ার পাশাপাশি যাত্রীরা চুক্তিতে চলতে বাধ্য হন।
তাছাড়া একটি মোটরসাইকেল বা কার কিনে মোবাইলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ডাউনলোড করে যে কেউই নেমে পড়ছেন ঢাকার রাস্তায়। এমনকি এক সময়ের রিকশাচালক, পান সিগারেটের দোকানদার কিংবা গ্রামের বেকার যুবকও এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকার রাজপথ। এ কারণে রাজধানীতে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা, সঙ্গে দুর্ঘটনাও।
অনেকে মনে করেন, এটা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অ্যাপ বন্ধ থাকলে চালক যেমন তার কোম্পানিকে ঠকাচ্ছেন, তেমনি ট্র্যাক করার সুযোগ থাকে না। দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ও কেউ নেবে না।
অ্যাপ ব্যবহারকারী একজন জানান, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর উবারের ওই চালক তার কাছে জানতে চান, তিনি কখন ফিরবেন। সময় জানানোর পর চালক বলেন, ফিরলে যেন তাকেই ফোন দেয়া হয়, অ্যাপে রিকোয়েস্ট পাঠাতে হবে না।
চুক্তিতে কেন যান, জানতে চাইলে চালক বললেন, অ্যাপের মাধ্যমে গেলে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে ভাড়ার একটি অংশ দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু অ্যাপস বন্ধ রেখে ওই ভাড়ায় যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিলে পুরোটাই চালকের থাকে।
এ ব্যাপারে উবার বলছে, তাদের নিবন্ধিত চালকদের নিজস্ব নীতিমালা ও স্থানীয় আইন মেনে চলা উচিত। আইন ভঙ্গ করা হলে উবার ওই চালকদের নিবন্ধন বাতিল করবে। এ ছাড়া যাত্রীদের এই ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে বলেছে এই রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান।
তারা আরও বলেন, ‘অ্যাপসে গেলে চালক ও গ্রাহক উভয়ের তথ্যই ট্র্যাকে থাকে। কিন্তু চুক্তিতে চালকের চাহিদামতো গেলে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় চলে আসে। এখানে নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের সঙ্গে তাঁদের কোনো পার্থক্য থাকল না।’
রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় এক সময় রিক্সা চালাতেন কাদের নামে এক যুবক। গত এক বছর হলো রিকশা বাদ দিয়ে তিনি এখন পাঠাও এর বাইক চালক। তবে তার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
জিয়াউর রহমান নামে আরেক যুবকের গল্পটাও কাদেরের মতোই। গ্রামের কাপড়ের দোকানে লাভ হচ্ছিলো না খুব একটা। তাই দোকান বিক্রি করে মোটরসাইকেল কিনে তিনিও এখন দিনভর বাইক চালান। একই অবস্থা লাখো বাইক ও কার চালকের।
বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে কর্মসংস্থান নিশ্চয়ই বড় চ্যালেঞ্জ, সেই জায়গা থেকে রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে নতুন চালকদের অদক্ষতায় মাঝে মাঝেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারকারী ফাতেমা বলেন, কিছু কিছু চালক আছে যারা ঠিক মতো চালাতে পারে না। যান-জট, সিগন্যাল কিছুই তারা মানে না।
অ্যাপে না গিয়ে যাত্রীরাও অনেক সময় নিজেরা চুক্তিতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এক যাত্রী বলেন, ‘অফিস শেষে এখানে এসে দাঁড়ালেই মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। ওনারাও জিজ্ঞেস করেন, কই যাব। তখন আর অ্যাপ খুলি না।’
তবে এই যাত্রী জানান, কখনো কখনো যে ভাড়া আসে, তার চেয়ে কিছু কমেও চুক্তিতে যাওয়া যায়। অ্যাপ কোম্পানিকে যেহেতু ভাড়ার অংশ দিতে হয় না, তাই চালকেরা কিছু কম রাখেন। চুক্তিতে চলার সময় মোটরসাইকেলে একসঙ্গে দুজন যাত্রী পরিবহনের চেষ্টাও চালকেরা করেন বলে অভিযোগ আছে।
মাসুদ রানা যিনি ঢাকার রাস্তায় প্রায় দেড় বছর ধরে পাঠাও ও উবার অ্যাপসের মাধ্যমে এ মটোরবাইক চালিয়ে আসছেন। রাজধানীর বনানী এলাকায় তার সঙ্গে কথা হলে তিনি কিছু সমস্যা তুলে ধরে বলেন, প্রথমে আমাদের যেসব সুবিধা দেয়া হতো এখন সে সকল সুবিধা দেয়া হয় না। এখন অ্যাপস প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রাইডের টার্গেট বেশি দেয়া যা পূরণ করা সম্ভব হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে তাদের যে বোনাস দেয়ার কথা ছিল তা দেয়া হয় না।
তিনি আরো বলেন, শুরুতে ওয়েটিং চার্জ থাকলেও এখন তেমন একটা নেই। পাঠাও প্রতিদিন ১৬ রাইডের টার্গেট দেয় বলে জানান রাইডার মাসুদ। সপ্তাহে ৪০ টি রাইড দিলে ৩০০টাকা, ৬০ টিতে ৫০০ টাকা, ৮০ টিতে ২৪০০টাকা এবং ১০৫ টিতে ৩৬০০ টাকা দেয় অ্যাপস প্রতিষ্ঠান উবার। তবে এই টার্গেট রাইডারের জন্য সহজ নয়। অ্যাপসের মাধ্যমে ভাড়া কম বলেও জানান এ রাইডার।
রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় সহজের বাইক রাইডার সুমনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রকৃত ভাড়ার চয়ে জিপিএস’র ভাড়া কম আসে। জিপিএস গুগলের মাধ্যমে সরল রাস্তার ম্যাপ অনুযায়ী ভাড়া দেখায় কিন্তু ঐ গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক ঘুরতে হয়। প্রতি রাইড থেকে তিনি ১৪ শতাংশ কমিশন দেন সহজ প্রতিষ্ঠানকে। এখানে তিনি আবার ওয়েটিং চার্জও পান না।
চুক্তিতে যাওয়ার বিষয়ে রাইডাররা জানান, অ্যাপসের মাধ্যমে ভাড়া কম আসে বিধায় অনেকে সরাসরি চুক্তিতে যান। সহজ’র এক রাইডারের সঙ্গে কথা বলার সময়ে এক যাত্রীকে পেয়ে তিনি চুক্তিতে চলে যান। অ্যাপসে না গিয়ে কেন চুক্তিতে যাচ্ছেন জানতে চাইলে রাইডার কিছু না বলে মুখে হাসি ছড়ান। চুক্তিতে যেতে ইচ্ছুক ওই যাত্রী রাজিবকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে অ্যাপসে সমস্যা দেখা দিয়েছে অথচ আমাকে জরুরি ভিত্তিতে গুলশান যেতে হবে।’
এমন চুক্তিতে যাওয়া কতটুকু নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর না দিয়েই তিনি চলে যান রাইডারের সঙ্গে। নাজমুজ সাকিব সাদি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এ প্রতিবেদকের ফেইসবুকে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠান। তিনি বার্তায় বলেন, ‘কেউ ১০০০ টাকা আয় করলে অ্যাপস কোম্পানিকে ২৫০ টাকা দিতে হয়। সারাদিন রাস্তায় তেল খরচ হয় ৩০০ টাকার। সারাদিনের খাবার-নাস্তা বাবদ খরচ হয় ২০০ টাকা। এরপর তার মূল আয় দাঁড়ায় ২৫০ টাকা। বিষয়টিতে শোষণ স্পষ্ট হচ্ছে দাবি করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৫ শতাংশের জায়গায় ২ শতাংশ কমিশন নেয়ার প্রস্তাবের কথা বলেন তিনি।
রাইড শেয়ারিং শুরু হওয়ার পর সারা দেশ থেকে বেকার যুবকেরা রাজধানীতে এসেছিলেন বাইক বা কার চালাতে। এতে করে তাদের বেকারত্ব কিছুটা ঘুচলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। বিস্তর প্রশিক্ষণ না থাকায় রাইডাররা ঢাকার রাস্তায় চলাচল করতে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা যাত্রী বা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে তারা ভালো ব্যবহার করেন না এমনটি বলছিলেন ফজলে শাহরিয়ার।
বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমিনুল মোমিন রাইড শেয়ারিং এ ভাড়া কমানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অ্যাপস প্রতিষ্ঠানের উচিত রাইডারদের কাছ থেকে কম কমিশন নেয়া।’
অন্যদিকে যারা রাইডার হিসেবে কার বা বাইক চালান তাদেরকে ইনসুরেন্স সুবিধা দেয়ার কথা অ্যাপস প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি বলে জানান রাইডাররা।
অ্যাপ বন্ধ রেখে চুক্তিতে চলাচলের বিষয়টি সব রাইড শেয়ারিং কোম্পানিই কমবেশি টের পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে অ্যাপ সেবা দাতারা নিরাপত্তার জন্য যাত্রীদের সতর্ক করে যাচ্ছে এবং রাইডারদেরও অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলো চালকদের শুধু নিজেদের অ্যাপ ব্যবহারবিধি শেখায় কিন্তু ড্রাইভিং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে না। যে কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমছে না। ঢাকা শহরের পরিবেশের সঙ্গে রাস্তার নিরাপত্তা, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে তাদের জানাশোনা না থাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
ঢাকার রাস্তায় শুধু বাইকের মাধ্যমে কত লাখ চালক রাইড শেয়ারিং এ যুক্ত আছেন তার হিসেব নেই কারো কাছে। কতজন বাইক চালক পাঠাওতে যুক্ত আছেন তা জানতে টানা তিনদিন চেষ্টা করেও পাঠাও এর কাছ থেকে মেলেনি তথ্য।
তানভীর রাসিব হাশেমী:গণমাধ্যমকর্মী
সান নিউজ/সালি