ইসমত শিল্পী:
৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সব নারীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই উপলক্ষ্যে। তবে এও বলি, নারী দিবস শুধু উদযাপনের নয়। কারণ যখন আজকের দিনে এসেও শুনতে পাই, ‘নারী দিবস চাই না, মানুষ দিবস চাই।’ তার মানে কি দাঁড়ায়? তার মানে নারী মানুষ হতে পারে নি এখনও। এমনকি মানুষও মানুষ হতে পারে নি। নারীদের সম্পর্কে এই শব্দগুলো শুধু এখন বা আজকে বলা হচ্ছে তা নয়। একটা/দুটো শ্রেণীর মানুষ তো বলেই এসেছে- নারী এখনও মানুষই হয়নি। হ্যাঁ, নারী মানুষ হয়নি, মানুষ হতে পারে নি- এমন বাক্য আমরা পড়ি বা শুনি। ভেবে দেখেছি কি কখনো - এখানকার বৈষম্য? ভাবি নি। অথচ বৈষম্য ঘোচানোর জন্যই যত শ্লোগান। বৈষম্য দূর করণের সুবাদে যত মিছিল মিটিং সেমিনার। যতরকম চাওয়া। বলতে পারা যায় এভাবেও- বৈষম্য মানি না ক্ষেত্রে যত গলাবাজি, মানববন্ধন; নারীদের। কিন্তু হয়েছে কি ? হচ্ছে কিছু ? যদি হয়েছে ধরে নিই তাহলে কতখানি হয়েছে ? কোথায় হয়েছে, কীভাবে হয়েছে ? উত্তর---? সত্যিই জানা নেই।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। সে হোক বাইরে, কাজের জায়গায়। হোক ঘরে বিংবা পরিবারে। পরিবারে কন্যা শিশু হয়ে জন্মানোর পরপরই বৈষম্য শুরু পুত্র ও কন্যার ভিতরে। চিন্তাভাবনা ও কাজে। কন্যা সন্তানের লালন-পালন সহ শিক্ষারদীক্ষার বেড়াজাল সেই আদি থেকে। আজও যে নেই তা কিন্তু নয়।
আজও শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েও অনেক নারী নিজের অধিকারটুকুও আদায় করতে পারছেন না। নারীরা আজও মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারছেন না। সত্যি বলতে, নারীরা এখনো পুরুষতান্ত্রিকতার পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। শিক্ষিত হয়েও নারীরা নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন না। পুরুষতান্ত্রিকতার সমাজের শেকলের মধ্যে আটকে আছে নারীদের জীবন। কী নৃশংস, ভাবা যায়! অথচ নারীর শ্রম, নারীর সময়, নারীর শরীর সবকিছুই সমান করে দিতে চায় নারী নিজে। আর বিনিময়ে অধিকারের প্রশ্নে সুসমবন্টন। এই সুসমবন্টন, এখানেই যত ঝঞ্ঝাট। নারী তখন বিরক্তিকর। নারী তখন প্রতিবাদী। নারী তখন বিদ্রোহী। অথবা বেপোরায়া এবং অহংকারী। অথচ এই অহংকার নারীর প্রাপ্য। আমার তো মনে হয়, নারী যে জন্মগতভাবে নারী-শুধু একারণেই মর্যাদার শ্রেষ্ঠ আসনটি তাঁর প্রাপ্য।
শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেও তাঁরা অধিষ্ঠিত। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোয় নারী প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমরা যদি ঘরে-বাইরে তাঁদের নিরাপত্তাই দিতে না পারি, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা রাজনীতির শীর্ষ পদে নারীর অবস্থান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে না।
অথচ নারীর ক্ষমতায়নের চাইতে বড় প্রয়োজন নারীর স্থিতিশীল জীবন ব্যাবস্থা। নিরাপত্তার জায়গায় ঠিক উল্টোটাই তো অধিক লক্ষ্যনীয়। নারীর নিরাপত্তহীণতা তো বেড়েই চলেছে। সামজ পরিবার এমনকি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও। যাঁরা প্রতিষ্ঠিত স্থানে আছেন তাঁদের ব্যতিক্রমী উদারণ কিন্তু সামগ্রিক চিত্র নয়।
নারীর নিরাপত্তার অবস্থা যখন এমন হতাশাব্যঞ্জক, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে—এটা সার্বিক বিবেচনায় কতটা অগ্রগতি, তা ভেবে দেখার বিষয়। তা ছাড়া অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনে। নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাস্তবে সেই পুরনো নীতিই চলমান।
নারী যদি সুবিধা বঞ্চিত না হন তাহলে সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে বাড়তি সুবিধা চাইবার প্রয়োজনও হবে না। নিরাপত্তা ও অধিকারের জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ না থাকলে তা চাইবার দরকারই বা কি ? নারীর নিরাপত্তার জায়গাটি আরও সুক্ষ্ণভাবে পর্যালোচনার দরকার আছে বৈকি। আজকের দিনে আমরা এই শুভকামনা করি।