স্বপন দত্ত
গণমাধ্যম একটি জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র, সরকার ও জনমানসের মধ্যে সংযোগ সাধনের বাহন। জাতীয় উন্নয়নে স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকার সর্বজনীন স্বীকৃতি আছে। স্বাধীন গণমাধ্যমই সামাজিক অসঙ্গতি, শোষণ-বঞ্চনা, দুর্নীতি, গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথাচিত্র রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরতে পারে। তাতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত সরকার গণমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিকারে এগিয়ে আসতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হনন করা হলে সরকার কালের প্রবাহে জনপ্রিয়তাহীন হয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে পড়ে যায়। এটা ইতিহাসের সত্য বাণী, যা প্রমাণিত।
গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যম জাতির চেতনায় বিবেকবোধের জন্ম দেয়। গণমাধ্যম নিজের ভেতরকার বহুস্বরের দায়িত্ব উচ্চারণ করে সর্বদা শত-সহস্রদৃষ্টির প্রহরা দিয়ে। সেইসাথে দায়িত্ববান গণমাধ্যম নিজস্ব জবাবদিহিতার বিচারক হয়ে আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের আলোকে সঙ্কটকালে ন্যায়ের বিধান রচনা করতে দায়বদ্ধতায় সাহসী ভূমিকা নেয়।
গণমাধ্যম শব্দটিকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এর বিস্ফোরক শক্তি সম্পর্কে আমাদের জানার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা গণমাধ্যমকে একটি "সামাজিক পরমাণু" নামে যদি চিহ্নিত করি, তাহলে হয়তো-বা এর প্রকৃত পরিচয় খানিকটা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা যায়। আমরা জানি, পরমাণুর নানামুখী ব্যবহার আছে। তার ভয়াবহ ব্যবহারের যথার্থ উদাহরণ আমরা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি নগরীর ধ্বংসচিহ্ন থেকে পাই, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান-লগ্নে, বলা যায়, প্রয়োজন না-থাকা সত্ত্বেও পরমাণু বোমার কার্যকারিতা কতোটুকু তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিক্ষেপ করেছিলো। অথচ, এর আগেই জাপান আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো।
পরমাণুর জনহিতকর ব্যবহারের দিকটি হলো, একে উন্নয়নমুখী শক্তির রূপে প্রয়োগ করা। জৈব-জীবাশ্ম জ্বালানী তেল-গ্যাস-কয়লার পরিবর্তে পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহার যেমন পরিবেশবান্ধব রূপে স্বীকৃত, তেমনই এর ব্যবহার রয়েছে রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। গণমাধ্যম আসলে এমনই বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য একটি শক্তি। যথোচিতভাবে পরিচালনা করা হলে এর জনবান্ধব ও সমাজবিকাশক ভূমিকা নানা ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই।
গণমাধ্যম বলতে আমরা বাস্তবে, একসময় কেবল প্রিন্ট মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্রকেই বুঝতাম। কালক্রমে, সরকারি-বেসরকারি রেডিও-টেলিভিশন তথা ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও একই পর্যায়ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক কালে, প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে এসবের সাথে আরও একটি সহযোগী মাধ্যম এতে যুক্ত হয়েছে। যাকে, আমরা অনলাইন নিউজ পোর্টাল নামে অভিহিত করেছি। এটি বলতে গেলে একটি তাৎক্ষণিক খবরের যোগানদায়ক ইন্টারনেটনির্ভর ইলেকট্রনিক সংবাদপত্র, যাকে দৈনিক পত্রিকার মতো, মুদ্রণের নিমিত্তে ২৪ ঘণ্টার বিলম্বিত সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হয় না। কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পরই তা ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে আগ্রহী পাঠকের দরবারে পৌঁছে যায়।
উল্লিখিত তিনটি গণমাধ্যমের মধ্যে অনলাইন পোর্টালের নিউজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। তাই, এর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনলাইন সংবাদপত্রের সাথে বেশ কিছুটা পাল্টা দিতে সক্ষমতা দেখাবার ক্ষমতা রাখে। তবে, মুদ্রিত দৈনিক সংবাদপত্র উপরোল্লিখিত দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতায় নামবার সামর্থ্য রাখে না। কেননা, মুদ্রিত গণমাধ্যম তথা দৈনিক সংবাদপত্র পাঠকের হাতে আসে ২৪ ঘণ্টা পরে। সেখানে যে সমস্ত খবরা-খবর ছাপানো হয় তার অনেক কিছুই আগের দিনই আংশিক বা সংক্ষিপ্তাকারে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে শ্রোতা-পাঠকেরা জেনে যাওয়ার সুযোগে পেয়ে যায়। এটাই চ্যানেল নিউজ কিংবা অনলাইন নিউজের জন্যে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে দেয়। সেই অর্থতে দৈনিক গণমাধ্যম তথা মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলো একশ্রেণীর শ্রোতা-পাঠকের কাছে পুরোনো বা বাসী খবরে পরিণত হয়। ফলে তরা মুদ্রিত সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে।
তবে, ছাপাখানার অক্ষরে ছাপা স্থায়ীভাবে মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। যা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শ্রোতা-পাঠকেরা সহজে পায় না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শ্রোতা-পাঠকেরা যেসব সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে পায় তা হয় সংক্ষিপ্ত। প্রকৃতপক্ষে, সেসব খবরা-খবরের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও বিচার-বিশ্লেষণ পাওয়া যায় কেবল মুদ্রণ-মাধ্যমের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে। খবরের ভেতরের খবর জানতে হলে দ্বারস্থ হতেই হবে মুদ্রিত সংবাদ মাধ্যমের বাহনগুলোর কাছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে প্রিন্ট মিডিয়াই একমাত্র ভরসা। গবেষণামনষ্ক পাঠকসমাজের কাছে, তাই, মুদ্রিত দৈনিক গণমাধ্যমই এখনও নির্ভরতার প্রতীক। এমন একটি বড়ো অংশের পাঠকের কাছে দৈনিক সংবাদপত্রের চাহিদা থেকেই যাবে। এসবের ব্যক্তিগত সংরক্ষণের সুযোগ ও সহজপ্রাপ্যতা সাধারণ সমাজের মানুষের কাছে কম ঝামেলাপূর্ণ।
বলা হয়, একালের ব্যস্ত মানুষদের সময় স্বল্পতার কথা। মানুষ এখন জীবন জীবিকার চাপে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের কাছে সময়ই নেই দৈনিক পত্রিকা খুঁজে পাতার পর পাতা খুলে সংবাদ সমুদয়ের দীর্ঘ বর্ণনা পাঠ করার। এ পর্যবেক্ষণটি সর্বাংশে সমর্থনযোগ্য নয়। অতিব্যস্ত যাঁরা তাঁদেরও সময় থাকে না মনোযোগ দিয়ে নিউজ চ্যানেলগুলোর সংবাদ শোনার। এমন ব্যস্তজনেরা স্মার্ট মোবাইলে অনলাইনের নিউজ খুঁজে খুঁজে একেকটি সংবাদ পাঠ করার মতো অবসর খরচ করতে পারবে কি? এক পলকে অনেক সংবাদের উপর চোখ বুলানো যায় কেবল প্রতিদিনের মুদ্রিত নানান সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়।
আসলে, আজকের সমাজে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা, সংবাদ-সঙ্গীত-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। গণমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁদের মতামতের কোনো মূল্য থাকার কথা নয়। তবে যে বিষয়টি বিচার্য, তা হলো, সমাজের একটি শ্রেণীস্তরে অনলাইন পোর্টাল নিউজের চাহিদা আছে। তাদের নানা পর্যায়ের চাহিদা পূরণের জন্য এই গণমাধ্যমটির বাজার ক্রমশ বাড়ছে। আজকের বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী যুগে নিয়ত ঘটমান দেশ-বিদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংবাদের কাঁধে ভর করে পুঁজি তার উৎপাদিত পণ্যের বিজ্ঞাপনের মারফত দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্যসমূহের ব্যবহারিক উপযোগিতা শ্রোতা-পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। তাই অনলাইন নিউজ পোর্টালসমূহের প্রতি তাদের পৃষ্ঠপোষকতাও উদার আর সম্প্রসারণশীল। অর্থাৎ দৈনিক গণমাধ্যম, সংবাদপত্রের চাইতে অনলাইন পোর্টাল গণমাধ্যম প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকছে। দৈনিক সংবাদপত্রের টিকে থাকার জন্যে শুরু হয়েছে কৌশলী প্রতিযোগিতা। তাই, বর্তমানে কিছু কিছু দৈনিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিজেরাই অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংস্করণে হাত দিয়েছে। কেননা, দিনে দিনে তারা হয়ে পড়ছে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। অথচ, এককালে এই গণমাধ্যমটিই ছিলো অতি জনপ্রিয়।
কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বিনোদননির্ভর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। নানা সাংস্কৃতিক সাক্ষৎকার, নাটক, গান, অন্যান্য আনন্দ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সংবাদ প্রচার এবং "টক-শো" নামক বিশেষ বাণিজ্য কৌশল প্রয়োগ করে শ্রোতা-দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারছে। এভাবে দর্শক-শ্রোতাদের ধরে রাখার মতো আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক কৌশলের ভিত্তিতেই তারা হয়তো-বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাথে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। তবে, অনলাইন নিউজের ভোক্তাশ্রেণী ক্রমশই বেড়ে যেতে থাকবে জনগণের শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে। সেই পরিবেশে, নবযুগের আহ্বান উপেক্ষা করতে না-পারার কারণেই আরো বেশী সংখ্যক লোকজনের হাতে হাতে স্মার্ট মোবাইলের প্রাচূর্য বেড়ে যাবে। এবং "শর্ট কাট" উপায়ে জগৎ জানার বাসনা পূরণে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নামের গণমাধ্যমপ্রেমীর বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। এটাই হয়তো হয়ে উঠবে প্রযুক্তির অনুগামী যুগের বাস্তবতায়।
এখানে একটি গভীর বার্তা দেওয়ার বিষয় এই যে, আজকের ফেসবুকসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রকৃতঅর্থে গণমাধ্যম রূপে অভিহিত করা যাবে না। সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কখনও কখনও সামাজিক শক্তি রূপে কাজ করলেও এর কোনো স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক সত্তা নেই। কাঠামোগত শৃঙ্খলা নেই। এতে কোনো পুঁজি বিনিয়োগও নেই, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও নেই। দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা না থাকায় এরা মূল্যবোধে সঙ্কট সৃষ্টি, বিশৃঙ্খলা আবাহন, অপপ্রচার, জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্র কাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী দানবের আকারও ধারণ করতে পারে। মূল কথা হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক গুণ আপাতত দেখা গেলেও, কার্যত এটি আমাদের আলোচ্য গণমাধ্যমের মতো গণস্বার্থ রক্ষা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, চিন্তার স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠন রূপে দায়িত্ব গ্রহণ করে না। দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা না থাকলে এ জাতীয় যোগাযোগ সংস্থা সর্বদাই জনবান্ধব থাকে না। আমাদের অতীতে এ জাতীয় লোকসানি বিপর্যয়ের নিদর্শন আমরা দেখতে পেয়েছি।
গণমাধ্যম একালে তার অতীতের জন্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে মহীরুহ প্রমাণ প্রতিষ্ঠানিক শিল্প তথা ‘নিউজ ইন্ডাস্ট্রি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন এই শিল্পে চলছে বহুমুখী প্রতিযোগিতা। এখানে দুর্বল অবস্থানে আছে আদি গণমাধ্যম দৈনিক সংবাদপত্র।
এই গণমাধ্যমকে আজকের বাস্তবতায় অস্তিত্বের সংগ্রাম নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে হচ্ছে। তাঁদের ভরসা কেবল সেইসব পাঠক যাঁরা সংবাদের ভেতরের সংবাদে যেতে চাইবেন, বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ-প্রবন্ধ পড়তে আগ্রহী হবেন। আর, যাঁরা হবেন সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির সমজদার। এই গণমাধ্যমের জন্যে আজকের দিনে চলার পথটি অতি কঠিন। পুঁজির প্রতাপের মুখে প্রতিযোগিতাপূর্ণ জীবিকার ব্যস্ততার ভেতরে বসবাস করা মানুষগুলোর যদি নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় না থাকে, তবে তা-ই হয়ে উঠবে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন গণমাধ্যম দৈনিক সংবাদপত্রসমূহের জন্যে দুঃসংবাদ।
গণমাধ্যমের নিজেদের মধ্যকার এই প্রতিযোগিতার ভিতরে আগামী দিনগুলোতে কার অবস্থান কেমন দাঁড়াবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
স্বপন দত্ত: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সান নিউজ/সালি