এম এ আজিজ : যে দেশে গণতন্ত্র যতটুকু, সে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও ততটুকু। সাংবাদিকতার স্বাধীনতাবিহীন সমাজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বৈষম্যহীন সমাজ, আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অলীক স্বপ্নমাত্র। তাই মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রস্তুতিস্বরূপ সব অনৈতিক ও দুষ্টচক্রের কবজা থেকে গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হবে।
আরও পড়ুন : আগে নিরাপত্তা পরে অন্য হিসাব
গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যাশিত ভূমিকার কারণে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা ‘গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন সমাজ, আইনের শাসন ও সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এগিয়ে নিতে হলে গণমাধ্যম সংস্কারের এখনই সময়।
শিকড় থেকে বিকশিত সংস্কৃতি ও দায়িত্বশীল অধিকারবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনে নাগরিক ও গণমাধ্যমের মধ্যে আদান-প্রদান প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তাদের সঠিক তথ্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি এবং সেটি ধরে রাখতে পারাই গণমাধ্যমের অন্যতম দায়িত্ব। সেটি অর্জন করতে অবশ্যই গণমাধ্যকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী হতে হবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতি অনুগত সুবিধাভোগী ও অসাধু চক্রের কবজায় চলে গিয়ে অধিকাংশ গণমাধ্যম অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। এ ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের বেশকিছু আইন, নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় মুক্ত গণমাধ্যমের পথ চলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন : সকলের সচেতনতায় ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব
সমাজের অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিক। অসংগতি, অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সব ঘটনা-দুর্ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহভাবে জনগণকে অবহিত করাই গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা, কালো টাকা, মাফিয়া চক্র এবং অপসাংবাদিকতার কারণে গণমাধ্যম ছিটকে পড়েছে এ দর্শন থেকে। পাশাপাশি এই দর্শনে বিশ্বাসী সাংবাদিকদের ভূমিকা, সুরক্ষাও সংকুচিত। কারণ, সাংবাদিকদের মূল শক্তি তাদের ইউনিয়নও এখন রাজনৈতিক লাইনে বিভক্ত। গণমাধ্যমকে তার মূল দর্শনে ফেরাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
ষাট, সত্তর, আশি, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন সাংবাদিক-কর্মচারীসহ গণমাধ্যমের সুরক্ষায় অনেকাংশেই সক্ষম ছিল। সাংবাদিকতাকে মুক্ত গণমাধ্যমের দর্শনে ফেরাতে পেশাসংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথ সৃষ্টির জন্য কিছু প্রস্তাব দিচ্ছি।
আরও পড়ুন : অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি, এখনি সময় পরিকল্পনা গ্রহণের
১. সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন, দেশ-জাতির স্বার্থের বাইরে গণমাধ্যমকে কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ, সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে গণমাধ্যমের নীতি।
২. পেশায় বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিতে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট সবার আর্থিকসহ সব বিষয়ে সময়ে সময়ে স্বচ্ছতা যাচাই করতে হবে।
৩. যে গণমাধ্যম কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গোত্র, গোষ্ঠী বা পক্ষের প্রতি অনুগত, সেই গণমাধ্যম সরকারি আনুকূল্য ও সহযোগিতা পাবে না।
৪. কোনো সাংবাদিক পেশাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিযুক্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যাবে। কাউন্সিলের বিচারে অভিযোগকারী সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। কোনো সাংবাদিক ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সমন জারির আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
৫. বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, মালিক ও সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কমিটি লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে গণমাধ্যমের চাহিদা অনুযায়ী সাংবাদিক-কর্মচারীর এক বা একাধিক তালিকা তৈরি করে রাখবে। গণমাধ্যমগুলো এই তালিকা থেকে সাংবাদিক-কর্মচারী নিয়োগ করবে। তালিকাভুক্ত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে।
৬. কোনো সাংবাদিক বা কর্মচারী পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হতাহত হলে কর্মরত প্রতিষ্ঠান তাঁর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণসহ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্য ১৫ দিনের মধ্যে স্বজনদের বুঝিয়ে দেবে।
৭. প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত হবে। যে গণমাধ্যম সাংবাদিক-কর্মচারীদের সরকার নির্ধারিত বেতন-ভাতা দেবে না, সেটি সরকারি আনুকূল্য ও সহযোগিতা পাবে না।
৮. যে কোনো কারণে কোনো সাংবাদিক বা কর্মচারী চাকরি হারালে তাঁকে বেতন বোর্ড রোয়েদাদ অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় ওই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৯. স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সব আইন মুক্ত গণমাধ্যমের অনুকূলে সংস্কার করা হবে।
১০. সাংবাদিক ও কর্মচারীরা আলাদা ফেডারেশন এবং প্রয়োজনে প্রতিটি জেলায় আলাদা ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে। প্রতিটি ইউনিয়নের বার্গেনিং এজেন্ট গণমাধ্যমের মালিকের সঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে দরকষাকষি করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করবে।
১১. সরকারি বিজ্ঞাপন ঢাকার বাইরের গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ সুবিধা রেখে প্রচার সংখ্যা অনুপাতে বণ্টন করা হবে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল গণমাধ্যমের প্রচার, দর্শক বা শ্রোতাসংখ্যা অতি স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রয়োজনে তদন্ত করে নির্ধারণ করবে।
১২. গণমাধ্যমের জন্য ডিক্লারেশন বা ঘোষণাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর স্বচ্ছতা, আর্থিক সচ্ছলতা, উপযুক্ত অফিস, ছাপাখানা, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সাংবাদিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রেস কাউন্সিলের কাছে সন্তোষজনক বিবেচিত হতে হবে। ঘোষণাপ্রাপ্তি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক বিবেচনা বন্ধ করা হবে। এ বিষয়ে যে কোনো অনিয়মকারীর বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে প্রেস কাউন্সিল।
১৩. কোনো সাংবাদিক বা কর্মচারীর বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হলে একজন সাংবাদিক বা কর্মচারী পেনশনে যাবেন। স্বেচ্ছায় একজন সাংবাদিক বা কর্মচারী একটি প্রতিষ্ঠানে ১০ বছর কাজ করার পর পেনশনে যেতে পারবেন এবং প্রতিষ্ঠানও যে কোনো সাংবাদিক বা কর্মচারীর কাজের সময় ১০ বছর পূর্ণ হলে তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারবে। প্রতিষ্ঠান, কর্মরত প্রত্যেক সাংবাদিক ও কর্মচারী এবং সরকারের সমহারে আর্থিক অনুদানে পেনশন ফান্ড তৈরি হবে।
১৪. প্রেস কাউন্সিল, গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক-কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে।
এম এ আজিজ: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক