নুসরাত জাহান ঐশী: ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এরই মধ্যে ঘরমুখো মানুষ তাদের প্রিয়জনদের সাথে আনন্দ ভাগ করে নিতে নগর ছাড়ছে। নিরাপদে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশা সবার।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তা নয়, নিয়ম মেনে চলা
এদিকে ঈদযাত্রায় একই সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পরিবহনগুলোর। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের যাত্রা নিরাপদ করতে বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হয়।
তবে প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় যাত্রীদের সচেতনতার অভাবে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে সামান্য ভুলের কারণে দুর্ঘটনাবশত সঙ্গে থাকা মূল্যবান মালামাল হারানোসহ হতাহতের মতো ঘটনা ঘটছে।
তাই কেবল সরকারের তৎপরতাই যথেষ্ট নয়, যাত্রাকালে সাধারণ মানুষ যথাযথ নিয়ম মেনে চললে, তা তাদের নিজের ও অপরের জন্য স্বস্তি এনে দিতে পারে।
আরও পড়ুন: অমর একুশের চেতনা ও আজকের বাস্তবতা
আবার ঈদের সময় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে কিছু অসাধু চক্র মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে থাকে। তাদের দ্বারা চাঁদাবাজি, চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে যাত্রীরা বাড়তি বিড়ম্বনায় পড়েন।
এছাড়া বাস, ট্রেন বা অন্যান্য ছোট যানবাহনে অনেক সময় যাত্রীরা অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। ভিড়ের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। তাই যাত্রা নিরাপদ করতে এ বিষয়ে মাইকিংসহ পোস্টার বা লিফলেটের মাধ্যমে যাত্রীদের সর্তক করা হয়। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আরও পড়ুন: মাতৃভাষা বাংলা চাই: আমরা কোন পথে
অন্যান্যবারের মতো এবারও সাধারণ মানুষের ঈদযাত্রা ভোগান্তিমুক্ত ও স্বস্তিদায়ক করতে কাজ করছে পুলিশ প্রশাসন ও সড়ক বিভাগ। সড়কে যানজট নিরসন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে- যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ঈদের আগে ও পরে ৩ দিন করে মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ রাখা; যানজটের স্পটগুলো আগে থেকে চিহ্নিত করে সেসব স্থান নিবিড় মনিটরিংয়ের আওতায় রাখা এবং সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ইদের ৭ দিন আগে শেষ করা ইত্যাদি।
সেই সঙ্গে ইদযাত্রায় সড়কে কোনো আনফিট বা লক্কর-ঝক্কর গাড়ি সড়কে না চালাতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
ঈদ উদযাপনের জন্য কর্মজীবী মানুষের বাড়ি ফেরাকে ঘিরে অতিরিক্ত যাত্রী সামাল দিতে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে সড়কে যানবাহন চলাচল বেড়ে যায় বহুগুণে।
আরও পড়ুন: ৮ই ফাল্গুনের চেতনা ও আমাদের বাস্তবতা
সেক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যেমন- যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো, আগাম টিকিট বিক্রি ইত্যাদি।
তবে অনেক সময় দেখা যায়, অসাধু ব্যক্তিদের অতিরিক্ত উপার্জনের মানসিকতা, অনুমোদনহীন ও আনফিট গাড়ি সামান্য জোড়াতালি দিয়ে দ্রুত মেরামত করে চলাচল শুরু করা এবং অনভিজ্ঞ চালক নিযুক্ত করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, এবার ঈদে সড়কপথে ঢাকা ছাড়ছে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। ঈদের আনন্দ শুরুই হয় যেন ভোগান্তি দিয়ে। ঈদের আগে তীব্র যানজটের কারণে যাত্রীদের ঘন্টার পর ঘন্টা সড়কে আটকে থাকা যেন চিরায়ত ঘটনা। এ সময় ঘরমুখী মানুষ বহন করা গাড়ি যেন সড়কে স্থবির হয়ে পড়ে।
যানজটসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ভোগ নিয়ে এক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ অবস্থা। ঈদযাত্রা যেন কে কার আগে যেতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতা।
আরও পড়ুন: নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম
এসব দুর্ভোগের মধ্যে যে যেভাবে পারছে, বাড়তি মূল্য হাঁকিয়ে বসছে; বাস, সিএনজি থেকে শুরু করে রিক্সা, অটোর মতো ছোট ছোট যানবাহনগুলোও। এমন পরিস্থিতি যাত্রীদের জন্য বেশ বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে।
তবে সম্প্রতি সড়কপথে সরকারের নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে যানজট পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। এর মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রুটে চার লেনের সড়ক ব্যবহার, পদ্মাসেতু তৈরি, রাজধানীতে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়েগুলো যানজট কমাতে ভূমিকা রাখছে।
ঈদযাত্রায় যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে সরকার রেলখাতেও নানামুখী ব্যবস্থা নিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে সারাদেশে ৮টি বিশেষ ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষও আগাম টিকিট বিক্রিসহ স্টেশনে নানা ধরনের সেবা বাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: শেখ কামাল: বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পন্দন
তবে এতো কিছুর পরেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ঈদে ঘুরমুখো মানুষের দুর্ভোগ যেন অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কখনো কখনো টিকিট কালোবাজারির মতো ঘটনায় যাত্রীরা টিকিট না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। তখন বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে তাদের টিকিট কিনতে হচ্ছে।
আবার যাত্রীদের বিভিন্ন অসচেতনা ও বেপরোয়া আচরণের ফলে রেলে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঈদের সময়ে ভিড়ের কারণে প্রায়শই স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করা মাত্রই বহু মানুষ ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েন। অনেকে আবার ট্রেনের ইঞ্জিন বা দুই বগির সংযোগস্থলে অবস্থান নেন।
দুর্ঘটনা এড়াতে এমন ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল থেকে যাত্রীদের বিরত রাখতে কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও পড়ুন: শিশুদের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা
অন্যান্য মাধ্যমের পাশাপাশি দ্রুত ও নিরাপদ ভ্রমণে মানুষ আকাশপথেও ভিড় জমাচ্ছে। তাই যাত্রীদের সেবা দিতে ফ্লাইট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এয়ারলাইন্সগুলো।
আকাশপথে দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম হলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এ পথে যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিমান কর্তৃপক্ষকে আবহাওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের করে যাত্রা করতে হবে।
নৌপথে এক আতংকের নাম বাল্কহেড। প্রায়শই দেখা যায়, বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌযান ডুবে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও নির্দেশনা অমান্য করে অনেক সময় লুকিয়ে লুকিয়েই এগুলোও চলাচল অব্যাহত রাখা হয়।
তাই ঈদযাত্রায় নদীপথে নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডকে টহল বাড়ানোসহ দুর্ঘটনা রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হওয়ার কারণে প্রতিবছরই লঞ্চ ডুবে বিপুল পরিমাণ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপন করতে মানুষ অনেক সময় অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়েই যাত্রা করেন। এতে নানা দুর্ঘটনার সম্মুখীনও হন।
আরও পড়ুন: ধেয়ে আসছে ‘অনলাইন জুয়া’
তাই ঈদযাত্রায় ভিড়ের কথা চিন্তা করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। যাতে এই যাত্রাই শেষ বাড়ি ফেরা না হয়।
যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেকোনো নিয়ম বহির্ভূত ঘটনা রোধের পাশাপাশি সারাদেশের নৌযোগাযোগ খাতে সার্বিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ নেয়াসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, সবই করতে হবে।
চলতি মাসে ঈদের এ সময়ে কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ঝড়-বৃষ্টি ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া দু্র্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটার মাত্রা বাড়ে।
ঝড়-বৃষ্টি নৌপথে যাত্রার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে। আবার ঝড়ের কারণে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় যাত্রার সময়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন: শিক্ষকের কাজ জ্ঞান ছড়ানো, ঘৃণা নয়
বিমান চলাচলের ক্ষেত্রেও আবহাওয়ার কারণে যাত্রায় বিলম্ব হতে পারে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কর্তৃপক্ষকে যাত্রী পরিবহন করতে হবে এবং যাত্রীদের বিষয়টি আগে থেকেই অবগত করতে হবে।
অপরদিকে বিরূপ আবহাওয়ায় নৌপথে সতর্কতা হিসেবে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট এবং বয় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সেক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশের যথাযথ তদারকি থাকলে নৌপথে যাত্রা নিরাপদ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
গতবছর ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১৫ দিনে দেশে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৫৬৫ জন আহত হন। সেবার ঈদুল ফিতর উদযাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২১.৬ জন নিহত হন।
আর সারাবছরই সড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন মোটরসাইকেল আরোহীরা। ঈদের সময়ও তার ব্যতিক্রম নয়। মোটরসাইকেলে যাত্রা যথেষ্ট অনিরাপদ হওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। এমনকি নানা শাস্তির আওয়তাও আনা হয় তাদের। তবুও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমছে না।
আরও পড়ুন: বৃক্ষনিধন নয় বৃক্ষরোপণই জরুরি
তাই নিজের নিরাপত্তার জন্যই এ বাহনটির চালককে আরও সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের ট্রাফিক নির্দেশনা যথাযথভাবে মানতে হবে।
ঈদযাত্রায় অনেক সময় দেখা গেছে, যাত্রীদের প্ররোচনায় গাড়ি দ্রুত চালাতে উদ্বুদ্ধ হন চালকরা। দূরের পথে বাসে যাত্রার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রায়শই চোখে পড়ে। এমন পরিস্থিতি একসঙ্গে অনেক মানুষ জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে।
তাই কেবল প্রশাসন একাই নয়, যাত্রীদের অসচেতনতাও দুর্ঘটনা সৃষ্টিতে বহুলাংশে দায়ী।
মূলত স্বজনদের সাথে ঈদ উদযাপন করার লক্ষ্যে এ সময় সবাই স্বস্তি ও আনন্দের সাথে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে চান। ঈদের সাথে সবারই তীব্র আবেগ জাড়িয়ে থাকে। সবাই চান নিরাপদে বাড়ি ফিরে আপনজনদের সাথে আনন্দঘন সময় কাটাতে।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ যাত্রা আরও নিরাপদ ও ভোগান্তিমুক্ত করা সম্ভব হবে।
লেখক:
গণমাধ্যমকর্মী