অন্তরা আফরোজ* : আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই দিনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ট্রেন্ড আর এ্যালগোরিদমে চাপা পড়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ( দ্যা মিসটেরিয়াস মিউজিকাল সুন্দরবন)।
যেখানকার জনপদ মানুষ খেকো প্রাণীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকে। প্রতিটা পদক্ষেপে যেখানে রয়েছে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূল, গা- গলানো কাঁদামাটি, বনে বাদড়ে বিষাক্ত সব সাপের সমাহার এবং অন্তহীন অরণ্যের পথ ধরে বয়ে চলা সব মিলিতে প্রায় ১৭৭ টি নদীতে ধারালো দাঁতের ভয়ংকর সব কুমির। এমনকি গহীন অরণ্যে লবণাক্ত ভেজা মাটি পেরিয়ে দেখা মেলে ডাকাত দলের। ডাকাত নয় জলদস্যু। যেখান থেকে ফিরে আসার রাস্তা শুধুমাত্র সেই সব ডাকাত দলের লোকেরাই জানে। এছাড়াও এখানকার মানুষের জনজীবন আলাদা,ধর্ম বিচিত্র পূর্ণ, উপাসনার ধরণ আলাদা। সেখানে মানুষের কাজ হলো বাঘ শিকার আর বাঘের কাজ হরিণ শিকার।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এখন পর্যন্ত ঘুর্ণিঝড়, সকল বিপদ- আপদ, এর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব সুন্দরবন দিবস। নানাবিদ কারণে আমাদের পরম ভালোবাসার সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই সুন্দরবন বিলুপ্ত হলে জানা অজানা সকল তথ্য, ইতিহাস, জীবন ও জীবিকাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভৌগলিকভাবে সুন্দরবনের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘিরে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর তিন ভাগের দুই ভাগই পড়েছে বাংলাদেশে। অপর এক ভাগ পড়েছে ভারতে। বাংলাদেশের ম্যাপের দিক লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে৷ বঙ্গোপসাগরের উপকূল অনেকটা ফ্যানেল ও চোঙ্গা আকৃতির।
অন্যদিকে আবহাওয়াবিদদের মতে, সাগর ফ্যানেল ও চোঙ্গার দিকে তীব্র বাতাস ঠেলতে থাকে। যার কারণে বঙ্গোপসাগর অনেক বেশি ঘুর্ণিঝড় প্রবণ। কিন্তু মহান স্রষ্টার লিলাখেলায় যেমন দিয়েছেন ঝড় তেমনি সেই ঝড় মোকাবেলার জন্য রয়েছে ঢাল হিসাবে সুন্দরবন। এমনকি বিগত যত ঘুর্ণিঝড় দেশের উপর দিয়ে গিয়েছে সুন্দরবন ঢাল হয়ে সকল বিপর্যের সম্মুখীন হয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে দেশের জনপদকে বাঁচিয়ে রেখেছে সুন্দরবন। এখন কথা হচ্ছে এতো সমস্যা প্রতিকুলতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেনো এখানে বসতি গড়ে তুল্লো। বাঘকে প্রতিবেশি বানিয়ে আর তাদের রক্ষাকারী বনবিবির আসল রহস্যই বা কি।
সূত্রমতে আজ থেকে ৩০০-৪০০ বছর আগে খুলনার জেলা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সুন্দরবন। তবে এই বন উজাড় করে বসতি স্থাপন শুরু হয় মুলত বৃটিশ আমল থেকে। অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ইতিহাস ও জনসংস্কৃতি বইয়ের তথ্যমতে রাজস্য ও বুভুক্ষু বৃটিস প্রসাশনের চোখে পতিত এলাকা। যা কিনা আবাদ করতে পারলে সবদিক থেকেই লাভ। ১৭৭০ সালে কোম্পানির ক্যালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেল সর্বপ্রথম সুন্দরবনের জমি আবাদের জন্য ইজারা দেওয়া শুরু করে। তারপর থেকেই মানুষ এখানে বসবাস করতে শুরু করে। এই বনে রয়েছে বিষাক্ত সাপ, বাঘ, কুমিরের তীক্ষতা, জলাভূমির জোয়ার ভাটার খেলার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা মানুষের আত্নকাহিনী।
অন্যদিকে এই প্রতিকুল সকল পরিস্থিতি থেকেই সুত্রপাত হয় মিথলজিকাল ক্যারেক্টর সুন্দরবনের দেবী বনবিবির। সুন্দরবনের মানুষের কাছে এই বনবিবি হলো রক্ষাকর্তা। সেখানে সকল ধর্মের লোকেরাই বনবিবি আরাধণা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাতৃভূমির এই সুন্দরবন সত্যিকার অর্থেই আজ তা হুমকির মুখে। পানি ও মাটির লবাণক্ততা বাড়ার কারণে প্রচুর গাছপালা যেমন মারা যাচ্ছে তেমনি নানা প্রজাতির প্রাণীও বিলুপ্তির পথে।
গবেষকদের মতে, আগামী ২০-৩০ বছর পর সুন্দরবনের সুন্দরী গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেভাবে সুন্দরবন ঘুর্ণিঝড় ও প্রতিকুল সকল বৈরি পরিবেশ থেকে আমাদের আগলে রাখে। আমাদের সকলেরও উচিত সুন্দরবনকে আগলে রাখা। সুন্দরবন না থাকলে বড় বড় ঝড়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর মতো তখন আর কিছু থাকবে না।
* শিক্ষার্থী, তেঁজগাও কলেজ, ঢাকা।
সান নিউজ/এআর