অরক্ষিত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভ
ঐতিহ্য ও কৃষ্টি

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও অরক্ষিত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভ

রাশেদুর রহমান রাশু:

বেনাপোল (যশোর): যশোরের সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শার কাশিপুর পুকুরপাড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদসহ সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তারা দেশের জন্য প্রাণ হারিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে আছেন এখানে। তবে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখসহ সাত শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ অরক্ষিত রয়ে গেছে স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও।

শার্শা। উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তঘেঁষা গ্রামের নাম কাশিপুর। ওপারে ভারতের চব্বিশ পরগনার বয়রা। বাংলাদেশ সীমান্তের গোবিনাথপুর আর কাশিপুর মৌজার সীমানার মধ্যেই শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখসহ সাত শহীদের কবর ও স্মৃতিস্তম্ভ। অন্য ছয়জন হলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ, শহীদ সুবেদার মনিরুজ্জামান (প্রাক্তন ইপিআর), শহীদ সৈয়দ আতর আলী (তদানিন্তন গণপরিষদ সদস্য), শহীদ বাহাদুর আলী, শহীদ সিপাহী আ. ছাত্তার বীরবিক্রম (প্রাক্তন ইপিআর) ও শহীদ সিপাহী এনামুল হক বীরপ্রতীক (প্রাক্তন ইপিআর)।

তাদের সাতটি স্মৃতিস্মম্ভ প্রতি বছর ধুয়ে-মুছে জাতীয় দিবসগুলো পালন করেই যেন দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। কিন্ত সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। সীমান্তঘেঁষা অজপাড়া গাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভগুলো আজও পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সেগুলো আজ বনে-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। তাদের স্মরণে এখানে মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম স্থাপনের কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারিভাবে তদারকি করতে এলাকাবাসী কেয়ারটেকার রাখার দাবি জানালেও তা হয়নি।

শনিবার ( ৫ সেপ্টেম্বর) ছিল স্বাধীনতার সূর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদের ৪৯তম শাহাদৎ বার্ষিকী। সৈনিক জীবনের কঠিন কর্তব্য দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত না হয়ে জীবনের শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে গেছেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। তার সে চেষ্টা সার্থক হয়েছিল। নিরাপদে ফিরতে পেরেছিলেন সহযোদ্ধারা। শুধু ফিরে আসেননি নূর মোহাম্মদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি মর্টারের গোলা শেষে পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল তার জীবন প্রদীপ। পরে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায় এই বীরশ্রেষ্ঠর নিস্তেজ দেহটি। পাকিস্তানি হায়েনারা উপড়ে ফেলেছিল তার দুটি চোখ। দেহকে ছিন্ন ভিন্ন করেছিল বেয়নেটের খোঁচায়।

প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও তার মৃত্যু দিবসে ওই এলাকার স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে যান। ফুল দেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও। উপজেলা প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) এসব দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। কাশিপুর গ্রামবাসী মিলাদ দেন প্রতি বছর। তারা গর্ববোধ করেন একজন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিসৌধ তাদের গ্রামে থাকায়।

শনিবার কাশিপুর নূর মোহাম্মদ স্মৃতিসৌধে বিজিবি, উপজেলা প্রশাসন, সরকারি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল, বীরের সম্মানে গার্ড অব অনার, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জালি অর্পণ, রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়ার অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা।

এলাকাবাসী ও শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের পরিবারের সদস্যরা জানান, স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর ধরে নিরাপত্তাহীন থাকে। সেখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। বাইরের কেউ এলে বসার রুম বা রেস্টরুমের কোনো ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। তবে উপজেলা পরিষদ সচিবের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। এলাকাবাসী জায়গাটাকে সুন্দর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসম্বলিত যে সমস্ত স্থাপনা বা বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে কিছু কিছু জায়গায় কিছু কার্যক্রম নিয়েছি। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভেরও যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবো। মিউজিয়ামের বিষয়টিতো সময়াসাপেক্ষ। সেটিসহ সব বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের মহেশখালী গ্রামে জন্ম নেন। তার মায়ের নাম জেনাতুননেছা। বাবা আমানত শেখ। নূর মোহাম্মদ ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রগতি হয়নি। ছোটবেলায় তিনি তার বাবা-মাকে হারান। ১৯৬৯ সালে নূর মোহাম্মাদ ভর্তি হন ইপিআর বাহিনীতে (বর্তমানে বিজিবি)। তখন তার বয়স ২৩ বছর। ট্রেনিংয়ের পর তার পোস্টিং হয় দিনাজপুুর। সেখানে ছিলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। তারপর আসেন যশোর হেডকোয়ার্টারে।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সিপাহী নূর মোহাম্মদের সৈনিক মনে নাড়া দেয় স্বাধীনতা আর স্বদেশপ্রেম। সচেতন বিবেকবোধ তাকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করে। যশোরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ৮নং সেক্টরের অধীনে। নূর মোহাম্মদের প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক প্রশিক্ষণ থাকায় একটি কোম্পানির প্রধান নিযুক্ত করে যশোরের সীমান্তবর্তী গোয়ালহাটি টহলের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। মুক্তিবাহিনী বিকালে বাধা দেয় পাকিস্তানি বাহিনীকে। নূর মোহাম্মদের সঙ্গে ছিলেন দু’জন সহযোদ্ধা সিপাহী নান্নু মিয়া ও সিপাহী মোস্তফা। গোয়ালহাটির দক্ষিণে ছুটিপরে অবস্থান করছিল পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের ওপরে সার্বক্ষণিক নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বুঝে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। নূর মোহাম্মদসহ তিনজনও পাকিস্তানি বাহিনীর নজরে পড়ে যান।

চারপাশে অবস্থান নেয় শত্রুসেনা। শুরু হয় অবিরাম গুলিবর্ষণ। নূর মোহাম্মদ বুঝতে পারেননি যে, তিনি তার জীবনের শেষ যদ্ধের মুখোমুখি। সিপাহী নান্নুর হাতের হালকা মেশিনগানই ছিল তাদের প্রধান অস্ত্র। গুলি ছুড়তে ছুড়তে ফিরতে থাকে তারা তিনজন। এমন সময় হঠাৎ একটি বুলেট এসে সিপাহী নান্নুর বুকে বিধে বের হয়ে যায়। মাটিতে পড়ে যান নান্নু মিয়া। এলএমজি হাতে তুলে নেন নূর মোহাম্মদ। এক হাতে নান্নু মিয়াকে ধরা আর অন্য হাতে নূর মোহাম্মদের মেশিনগান দিয়ে বের হচ্ছে অবিরাম গুলি। কারণ, তিনি দলীয় অধিনায়ক। তার দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচানো। সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা। ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন তিনি । যেন শত্রুসেনারা বুঝতে না পারেন, কোনদিক থেকে কতাজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে লড়ছেন।

ঠিক এই সময় মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে নূর মোহাম্মদের ডান পায়ে। পা গুঁড়িয়ে যায়। শেষ পরিণতির কথা জেনে গেছেন নূর মোহাম্মদ। কিন্তু দমলে চলবে না। সহযোদ্ধদের বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে যেতে হবে তাকে। সহযোদ্ধা সিপাহী মোস্তফার একহাতে ছিল একটি এলএমজি। তাকে আদেশ দিলেন অবস্থান পাল্টে শত্রুর দিকে গুলি ছুঁড়তে। সেই সঙ্গে পেছনে ফিরতে। আহত নান্নুকে সঙ্গে নিলেন তিনি। তারপর নূর মোহাম্মদ এলএমজিটি আবারও নিলেন নিজ হাতে। শক্রদের ঠেকাতে থাকেন, যেন মোস্তফা নান্নুকে সঙ্গে করে স্থলঘাঁটিতে ফিরতে পারেন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে ফেরাতে পারলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়েন নূর মোহাম্মদ। পরে কাছের নিকটবর্তী একটি ঝোপের পাশে এই বীরের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

কাশিপুর সীমান্তের মুক্ত এলাকায় নূর মোহাম্মদকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করা হয়।

নূর মোহাম্মদের সহযোদ্ধারা একদিন দেশ স্বাধীন করলেন। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না। তার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। নূর মোহাম্মদের স্মৃতি আজও তার সহযোদ্ধাদের বুকে গভীর নিশিথের করুণ আর্তনাদের মতো বাজে। বাঙালির ইতিহাস চেতনায়ও তিনি সমুজ্জ্বল।

সান নিউজ/ এআর

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

লক্ষ্মীপুরে চাষ হচ্ছে সৌদির আজওয়া খেজুর

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি: মরুর দেশ সৌদি আরবের বিখ্যাত আজওয়া খেজু...

ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সায়েন্সল্যাবে ঢাকা কলেজ ও সিটি ক...

আ’লীগকে নির্বাচনে আনতে চাই বলিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আমরা কাউকে নির্বাচনে আনতে চাই, এমনটা বলিন...

কিয়েভে দূতাবাস বন্ধ করলো যুক্তরাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার ভয়...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ...

আইপিএলের আগেই নিষেধাজ্ঞায় হার্দিক

স্পোর্টস ডেস্ক: আইপিএলের গত আসর শুরুর আগে রোহিত শর্মাকে সরিয়...

খালেদা-ইউনূসের কুশল বিনিময়

নিজস্ব প্রতিবেদক: সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা সেনানিব...

পথে সড়কে প্রাণ গেল প্রধান শিক্ষকের

জেলা প্রতিনিধি: ফরিদপুর জেলার সালথায় স্কুলে যাওয়ার পথে দুই ম...

বহু বছরপর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক: সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজি...

২০২৫ সালে স্কুল ছুটি থাকবে ৭৬ দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা