মিরাজ উদ্দিন: ঋতুর পরিক্রমায় অবসানের বিদায় নেয় পুরাতন বছর। বিশীর্ণ জীর্ণ অতীতকে পশ্চাতে ফেলে নতুন বছরের নতুন স্বপ্ন নিয়ে আসে পহেলা বৈশাখ। আসে নববর্ষের শুভ সমুজ্জ্বল শুভক্ষণ। বাঙালির আবহমান জীবনধারায় নববর্ষ বিশেষ তাৎপর্য দিন।
আরও পড়ুন: সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি-এইচএসসি
জীর্ণ ক্লান্ত পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নববর্ষ জীবনকে এক নতুন অধ্যায় উপনীত হয়। আর উৎসবে আনন্দে মেতে উঠে সারা দেশ। পুরাতনকে ব্যর্থ অতীত আর দুঃখ-গ্লানি কে ধুয়ে মুছে মানুষ চিরকাল নতুনের স্বপ্ন রচনা করে তোলে। আর মানুষকে এ চিরন্তন প্রত্যাশাকে জাগ্রত করে তোলে নববর্ষ।
ভারতবর্ষের মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতে। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষিপণ্যের সাথে মিলিত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য হতো, খাজনা আদায়ের সুষ্ঠতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশের মত রাজকীয় জ্যোতিবিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরভ শাওন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে 10 মার্চ মতান্তরে 11 ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এ গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ পাঁচে নম্বর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। প্রথমে এই শহরের নাম ছিল ফসলী সন পরে বঙ্গাব্দ বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত লাভ করে।
আরও পড়ুন: বিএনপি নেতা ইশরাকের জামিন
নববর্ষ কেবল প্রাত্যহিকতার জন্য জীবন থেকে মুক্তির আর নতুন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসে না, বাঙালির জীবনে নববর্ষ আসে নানা অনুষ্ঠান আর উৎসবের ডালা সাজিয়ে। পহেলা বৈশাখ বাংলার প্রতিটি ঘরে মুখে হয়ে ওঠে নতুন আনন্দে। নতুন উদ্দীপনায়। প্রতিটি গৃহকোণ হয়ে ওঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নতুন পোশাকে নতুন শাড়ি গহনা সাজে অনেকেই।
হালখাতা, পুণ্যাহ, বৈশাখী মেলায় মেতে উঠে বাংলার গ্রামগঞ্জ ও জনপদ। হালখাতা নববর্ষের সাথে সম্পৃক্ত একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। প্রাচীনকাল থেকেই বণিক ব্যবসায়ী সমাজে থেকে হালখাতা প্রচলিত। আসলেই হালকা তা হল বাংলা সনের প্রথম দিনের দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা সকল স্থানে পুরনো বছরের হিসাব বই খোলা হয়।
আর এই সময় বণিকদের মাঝে মিষ্টান্ন করানোর জন্য একটি অনুষ্ঠানের ও আয়োজন করা হয়। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সংযুক্ত আরো একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো। পুর্ণাহ শব্দের মৌলিক অর্থ জমিদার কর্তৃক প্রজাসাধারণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক আনুষ্ঠানসূচক দিন।
এই দিনে প্রজারা নানা উপটোকন সহ খাজনা পরিশোধ করতে জমিদার মহলে উপস্থিত হতে। জমিদার প্রজাসাধারণ কে পান-সুপারি ও মিষ্টান্ন নদিয়া আপ্যায়ন করতো। এই অনুষ্ঠানে মাধ্যমে জমিদার ও পদের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় হত। কিন্তু কালক্রমে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায় যার কারণে আমরা এখন পুণ্যাহ এ অনুষ্ঠানটি দেখতে পায় না কিন্তু উপজাতিরা এই পুণ্যাহ অনুষ্ঠানটি এখনো পালন করতে দেখা যায়।
নগর জীবনেও বাংলা নববর্ষ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ও উৎসাহ উদযাপিত হয়। এ যেন বাংলার ইতিহাসের সাথে আধুনিকতার মেলা বন্ধন। ছেলেরা পড়ে যান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি,মেয়েরা পরিধান করে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে টিপ, হাতে বাহারি রঙের চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা। আর পহেলা বৈশাখের শুভক্ষণে নতুন বছরকে বরণ এর আয়োজনে রাজধানী ঢাকায় এক আনন্দ মেলায় পরিণত হয়।
নববর্ষকে স্বাগত জানাতে রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের কণ্ঠে থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশ্বত আগামীর গান এসো হে বৈশাখ এসো এসো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানের স্বাগত জানানো হয় বাংলা নববর্ষকে। চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা মুগ্ধ করে সকলকে। বাউল গান কবিতা পাঠ আলোচনা সভা পুতুল নাচ ইত্যাদির লোক সামগ্রীর রাজধানী ঢাকাতে বর্ষবরণের এক অপরিহার্য অঙ্গ। মাটির ছাকনিতে ইলিশ ভাজা আর লস্কা-পেয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির উপভোগ্য নাগরিক আয়োজন।
আরও পড়ুন: বিএনপি নেতা ইশরাকের জামিন
নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠান একটি সার্বজনীন অসম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান। এই বর্ষবরণকে উপলক্ষ করে বাঙালি জীবন এক আনন্দময় সামাজিক যোগাযোগ হয়। নববর্ষ আমাদের সামনের সম্ভাবনার যে নতুন আহ্বান বয়ে আনে তাকে জীবনের আনন্দ ও কল্যাণ আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
নববর্ষের উৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক চেতনা ও মানবিক চেতনা যেন আরো উজ্জীবিত হয়, আমরা যেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে পারস্পারিক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নির্মাণ করতে পারে সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী।
সান নিউজ/এনকে