সান নিউজ ডেস্ক: পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর হিন্দু জেনারেল ও আদিল শাহ সুরির প্রধানমন্ত্রী হিমুর বাহিনী এবং মোগল বাদশাহ আকবরের বাহিনীর মধ্যে। দিল্লীর যুদ্ধে তারদি বেগ পরিচালীত মোগলদের পরাজিত করে হিমু এক মাস আগেই দিল্লী জয় করেছিলেন এবং নিজেকে রাজা বিক্রমাদিত্য ঘোষণা করেছিলেন।
আকবর এবং তার অভিভাবক বৈরাম বেগ শহর পুনরুদ্ধার করার জন্য দ্রুত দিল্লী পৌছেছিলেন। ১৫২৬ সালের প্রথম পানিপথের যুদ্ধের স্থানের অদূরবর্তী পানিপথে দুই সেনাবাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
যদিও যুদ্ধের আগেই হিমু তার গোলন্দাজ বাহিনী হারিয়েছিল, তার বাহিনী সংখ্যায় বেশী ছিল। যুদ্ধের মাঝে হিমু চোখে অতর্কিত ভাবে তীর লেগে আহত হয়েছিলেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে অতর্কিতভাবে পড়ে যেতে দেখে তার সেনাদল আতঙ্কিত হয়ে হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলে হিমু ধরা পড়ে এবং পরে তার শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। এর ফলে আকবরের সুস্পষ্ট বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল।
মোগল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ূন রাজত্ব হারিয়েছিলেন যখন ১৫৪০ সালে সূর সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ সূরি তাকে ভারতের বাইরে বিতাড়িত করেছিল। দিল্লী এবং আগ্রার পতন হয়েছিল শের শাহর হাতেই।
পরবর্তীতে ১৫৪৫ সালে শের শাহের মৃত্যু হয়। তার উত্তরসূরী হয় ছোট ছেলে ইসলাম শাহ সূরি, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। ১৫৫৩ সালে তার মৃত্যুর পর সূর সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
এর ফলে বিদ্রোহী ও প্রদেশসমুহের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে হুমায়ূন এই বিবাদ কাজে লাগিয়েছিলেন এবং ১৫৫৫ সালের ২৩শে জুলাই মোগলরা সিকান্দার শাহ সুরিকে পরাজিত করে, এবং সবশেষে দিল্লী ও আগ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
ইসলাম শাহ সূরির আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারি, তার ১২ বছর বয়সী ছেলেকে তার মামা হত্যা কর এবং আদিল শাহ সুরি হিসাবে সিংহাসনে বসেছিলেন। যদিও নতুন শাসক রাজ্যের সমস্যার চেয়ে আনন্দজনক কাজে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
ওসব কাজ বেশিরভাগই রেওয়ারি থেকে আগত একজন হিন্দু, হেমুকে দেওয়া হতো যিনি সামান্য অবস্থা থেকে আদিল শাহর প্রধানমন্ত্রী এবং সূরি সেনাবাহিনীর জেনারেল হয়েছিলেন।
১৫৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি যখন হুমায়ূন মারা যান, তিনি বাংলায় ছিলেন। মোগল বাদশাহর মৃত্যু মোগলদের পরাজিত করার ও হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার আদর্শ সুযোগ করে দিয়েছিল।
হিমু বাংলা থেকে দ্রুত যাত্রা করেছিলেন এবং মোগলদের বায়ানা, ইতাহা, সাম্ভাল, কালপি এবং নারাউল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আগ্রাতে প্রশাসক শহর ত্যাগ করেছিলেন এবং হেমুর আসন্ন হামলার সংবাদ পেয়ে যুদ্ধ না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রশাসকের পিছু ধাওয়া করে হিমু দিল্লীর ঠিক বাইরে তুঘলাকাবাদে পৌছে যান, যেখানে তিনি মোগল প্রশাসক তারদি বেগ খানের সেনাবাহিনীর দেখা পান এবং তুঘলাকাবাদের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন।
১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধের পর তিনি দিল্লী দখল করেছিলেন। এবং বিক্রমাদিত্য (বিক্রমজিৎ) উপাধি ধারণ করে রাজকীয় মর্যাদা দাবী করে রাজ্য শাসন করেছিলেন।
তুঘলাকাবাদ থেকে বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে, হুমায়ূনের উত্তরসূরি ১৩ বছরের আকবর ও তার অভিভাবক বৈয়ারাম খাঁ দ্রুত দিল্লীর দিকে যাত্রা করেন। ভাগ্যে ভালো থাকায়, আলি কুলি খান সাইবানি পরে খান-ই-জামান দৈবাৎ হিমুর কামানের দেখা পেয়ে যান।
দূর্বল প্রহরার মধ্যে। সাইবানিকে ১০,০০০ অশ্বারোহী সেনার দলসহ আগে পাঠানো হয়েছিল। তিনি আফগানদের কাছ থেকে কামানের পুরো চালান দখল করে নিতে সক্ষম হন।
এর মধ্যে যারা অস্ত্র পরিত্যাগ করেছিল এবং যুদ্ধ না করে পালিয়ে গিয়েছিল তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটা হেমুর জন্য এক বড় ক্ষতি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর মোগল সেনাদল হিমুর সেনাদলের সাথে ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়েছিল। আকবর এবং বৈয়ারাম খাঁ, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আট মাইল দূরে পিছনে ছিলেন।
মধ্যখানে আলি কুলি সাইবানির ১০০০০ অশ্বারোহী সেনার দল, ডানে সিকান্দার খান উজবাক এবং বামে আবদুল্লাহ খান উজবাক মোগল সেনাবাহিনী কে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
অগ্রগামী সেনাদলকে নেতৃত্ব দিয়েছিল হুসাইন কুলি বেগ ও শাহ কুলি মাহরাম এবং তুর্কদের থেকে বৈয়ারাম খার বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
আফগান ঘোড়সওয়ারি নিয়ে গঠিত প্রথম শ্রেনীর ৩০,০০০ শক্তিশালী অশ্বারোহী সেনার দল ও ৫০০ হাতীর হস্তীবাহিনী হিসাব করলে হিমুর সেনাদল সাংখ্যিকভাবে উন্নত ছিল। প্রত্যেকটি যোদ্ধা হাতী ধাতব বর্মে সুরক্ষিত ছিল।
তাদের পিঠে মাসকেটিয়ার ও ক্রসবোম্যান ছিল। হাওয়াই নামের হাতীর পিঠে চড়ে, হিমু তার সেনাদলকে নিজেই অঅত্যন্ত দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার বামপাশে বোনের ছেলে রাময়া এবং ডান পাশ শাদি খান কাক্কার নেতৃত্ব দিয়েছিল।
হিমুর সেনাদল প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও প্রচুর আত্মবিশ্বাসী ছিল এবং হিমু সেই সময়ে আদিল শাহর হয়ে ২২ টি যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন। যদিও এ যুদ্ধে হিমুর কোন গোলন্দাজ বাহিনী ছিল না।
হিমু আক্রমন শুরু করেছিলেন এবং মুঘলদের ডান ও বাম অংশের উপর হাতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। যে সব সৈন্য এই গন্ডগোল এড়াতে পেরেছিল,তারা পিছু হটার বদলে পাশে চেপে গিয়েছিল।
মোগল বাহিনীর উন্নত ধনুর্বিদ্যার সাহায্যে তীর বর্ষণ শুরু করে, হিমুর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশ আক্রমন করেছিল। মোগলদের মধ্যভাগ এগিয়ে এসেছিল এবং একটি গভীর গিরিখাতের আগে রক্ষনাত্মক অবস্থান নেয়।
হিমুর হাতী বা অশ্ববাহিনী কেউই প্রতিপক্ষের নাগাল পেতে খাত অতিক্রম করতে পারেনি এবং অন্য পক্ষ থেকে ছোড়া ছুটন্ত অস্ত্রের আঘাতের জন্য অপ্রস্তুত নাজুক অবস্থায় ছিল।
ইতোমধ্যে মোগল অশ্বারোহী সেনাবাহিনী তাদের দ্রুতগামি বাহনে চড়ে পাশ থেকে ও পেছন থেকে হিমুর সৈন্য বাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়েছিল এবং বিশাল পশুটির পায়ে খোঁচা মেরে বা মাহুতকে ফেলে দিয়েছিল।
হাতিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা আরম্ভ করেছিল। হিমু তার হাতীকে টেনে থামিয়ে ছিলেন এবং আফগান আক্রমনের তীব্রতা হ্রাস পায়।আফগান আক্রমন শিথিল হয়ে যেতে থাকে।
এ অবস্থা দেখে আলি কুলি খান চারিদিক ঘুরে এবং পেছন দিক থেকে আফগান মধ্যভাগে আক্রমনের জন্য তার অশ্বারোহী সেনাদলকে নির্দেশ দেন। হাওয়াই এর উপর হাওদায় বসে যুদ্ধ পর্যবেক্ষন করে আক্রমন প্রতিহত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
সাদি খান কাক্কর এবং তার আরেকজন যোগ্য সেনাপতি ভগবান দাসকে পরাজিত দেখার পরও তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমনে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার হাতীকে বাধা দিতে আসা যে কাউকে বীরবিক্রমে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।
এটা ছিল বেপোরোয়া ভাবে লড়াই করা যুদ্ধ; কিন্তু মনে হয়েছিল যুদ্ধের প্রাধান্য হিমুর দিকে ঝুকে পড়েছে. মোগল সেনাবাহিনীর উভয় অংশকেই হিমু প্রবল যুদ্ধে পিছনের দিকে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হিমুর যুদ্ধের কৌশলে মোগল বাহিনীর মধ্যভাগকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য হস্তীবাহিনী ও অশ্বারোহী সেনাদলকে সামনে চালনা করেছিলেন। হিমু যখন সম্ভাব্য বিজয়ের চূড়ায়।
মোগলদের ছোড়া একটি তীর দৈবাৎ হিমুর চোখে আঘাত করে। ফলে হিমু প্রচন্ড আহত হয়ে পড়েন এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাকে পড়ে যেতে দেখে তার সেনাবাহিনীর ভেতর আতঙ্কের সূত্রপাত হয়েছিল।
যাতে তার রণবিন্যাস ভেঙে গিয়েছিল এবং হিমুর বিশাল বাহিনী ভয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। ফলে যুদ্ধে হিমুর হার হয়েছিল; যুদ্ধের ময়দানে ৫০০০ লাশ পড়েছিল এবং পালানোর সময় আরো অনেককে হত্যা করা হয়েছিল।
আহত হিমুকে বহনকারী হাতীটিকে ধরা হয়েছিল এবং মোগলদের আস্তানায় আনা হয়েছিল। বৈয়ারাম খা ১৩ বছর বয়সি আকবরকে হিমুর শিরচ্ছেদ করতে বলেছিলেন।
কিন্তু কিশোর সম্রাট আকবর মৃত্যুপথযাত্রীর উপর তরবারি উঠাতে অরাজি ছিলেন। হিমুর মাথা তরবারি দিয়ে স্পর্শ করতে আকবরকে প্ররোচিত করা হয়েছিল, এরপরই বৈরাম খা নিজেই হিমুকে হত্যা করেছিলেন।
হিমুর মাথা কাবুলে পাঠানো হয়েছিল যদিও তার দেহ দিল্লীর একটি প্রবেশদ্বারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অন্যান্য মৃতদের মাথা দিয়ে পরবর্তিকালে একটি মিনার নির্মিত হয়েছিল।
হিমুর সমর্থকরা পরে পানিপথের যেখানে হিমুকে শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। এটি এখন হেমুর সমাধি স্থান হিসাবে পরিচিত।
হিমুর মৃত্যুর পর,আদিল শাহর সৌভাগ্যও প্রচন্ড খারাপের দিকে মোড় নিয়েছিল। ১৫৫৭ সালের এপ্রিলে বাঙলার মুহাম্মাদ শাহর ছেলে খিজির খান তাকে পরাজিত ও নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল।
পানিপথের যুদ্ধ থেকে অর্জিত মালের মধ্যে হিমুর ১২০ টি হাতি যাদের বিধ্বংসী ক্ষমতা মোগলদের এতই মুগ্ধ করেছিল যে প্রানিগুলো তাদের সামরিক কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল।
সম্রাট আকবর এর প্রধান সেনাপতি বৈরাম খান সম্রাটের বিরাগভাজন হয়ে বন্দী হয়েছিলেন। শেষে তাকে মক্কা শরীফে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলে পথে ঘাতক কর্তৃক নিহত হয়।
(তক্ষশীলা থেকে সংগৃহীত)
সান নিউজ/এফএইচপি