পি আর প্ল্যাসিড
জাপানে মিতুল প্রথমে একটি বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্টে থালাবাটি ধোয়ার কাজ নিয়েছিল। সেই কাজ থেকে কোনো রকম ভাষা না জেনেই প্রমোশন হয় তার হলে। এই হলে কাজ করার জন্য ছিল রেস্টুরেন্টের পুরোনো আরো অনেক স্টাফদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। সবাইকে বাদ দিয়ে কেন মিতুলকে এমন কাজে প্রমোশন দেওয়া হয়েছিল মিতুল নিজেও এ নিয়ে তার হিসাব মিলাতে পারে না। রেস্টুরেন্টে প্রায় সবাই ছিল বাংলাদেশি, তার চেয়ে বড় কথা ছিলো এখানকার সকলেই ছিল প্রায় বরিশালের লোক।
কয়েক জন মাত্র ছিলেন অন্য জেলার। যে কারণে কাজের স্থানে পরিষ্কার একটা বিভাজন ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু মিতুলকে মালিক পক্ষ হলে কাজ করার সুযোগ দিলেও অন্য কেউ এ নিয়ে কথা বলেনি। বিষয়টি মিতুলের জন্য ছিল এক ধরনের সৌভাগ্যের বিষয়। সে শুরু থেকে মনযোগ দিয়ে তার কাজ করার পাশাপাশি মিনিটে মিনিটে সে ভাষা শিখতে থাকে। সুযোগ পেলেই কাগজে নতুন নতুন জাপানি শব্দ লিখে তা প্রয়োগ করতে চেষ্টা করে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্টের কোন গেস্ট বা তার সাথে যারা কাজ করেছেন, তাদের সাথে। ভুল হোক বা সঠিক হোক সে সাথের কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনো কিছুর অর্থ বা বাংলায় বলে তার জাপানি শব্দ ছোট নোট খাতায় লিখে রাখে। এরপর সুযোগ পেলে একা একাই সে তা উচ্চারণ করে।
এমনও হয়েছে যে, রেস্টুরেন্টে জাপানি কোনো গেস্ট ঢুকলে অন্যরা পরিকল্পনা করে মিতুলকে এগিয়ে দেয় সুবিধা মতো গেস্টদের কোনো টেবিলে বসানোর জন্য। এরপর পানি আর হাত-মুখ মোছার জন্য ভেজা টাওয়েল নিয়ে পাঠায় মিতুলকে। গেষ্টদের সাথে দু'চার কথা বলার মতো করে জাপানি ভাষায় কথা শিখিয়ে দিতেন ম্যানেজার বা অন্য কেউ। মিতুল সে সব মুখস্ত কথা তোতা পাখির মতো করেই বলতে চেষ্টা করতো আগত অতিথিদের সাথে। এ ভাবেই সে খাবারের অর্ডার নেওয়ার জন্য যে ধরনের কথা বলা দরকার, সে সব কথা রপ্ত করে প্রয়োগ করতে শুরু করে অল্প কয়দিনের মধ্যে।
এক সময় তাদের সাথে বাড়তি দু'চার কথা বলে নিজের পরিচয় দিতে শিখে যায় মিতুল। এতে করে দেখা যায় অল্প বয়স্ক কোনো মেয়ে বা মহিলা গেষ্ট আসলে তাদের সাথে হাসি হাসি করে কথা বলে তাদের ফোন নম্বর নিতে শুরু করে মিতুল। তখন থেকেই শুরু হয় তার ভিন্ন জগতে প্রবেশ করা। এ নিয়ে অনেকের সাথে তার ঝামেলাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। মিতুলকে এনিয়ে তাদের কেউ আবার হিংসাও করতে শুরু করে তখন।
একদিন জাপানের কয়েকজন ছাত্রী মিলে খেতে আসে তাদের সেই রেস্টুরেন্টে। ওরা কাছাকাছি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের সাথে কথা বলে মিতুলকে ফোন নম্বর বিনিময় করতে দেখে তাদের একজন মিতুলের পিছন লাগে। মিতুল এখনো ভালো করে জাপানি ভাষা বলতে পারে না, তাই ওদের ফোন নম্বর তাকে দিতে অনুরোধ করে বলে সে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। মিতুল এতে রাজি না হলেও অনেক অনুরোধ করে তাদের ফোন নম্বর যেন তাকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এমনও বলেছিল একজনের সাথে মিতুল সম্পর্ক করলে আরেক জনের সাথে সে বন্ধুত্ব করবে এবং এক সাথে তারা কোথাও ঘুরতে গেলে সে-ই তাদের সব খরচ বহন করবে। তাতেও মিতুল তাদের ফোন নম্বর তাকে দেয়নি। এতে করে তার সহকর্মীর সাথে অনেকটাই ভুল বোঝাবুঝি হয়।
মিতুল চেষ্টা করে হলের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই কিচেনে ঢুকে কিভাবে কারি রান্না করে তা দেখে শেখার জন্য। এমনকি কিভাবে নান রুটির খামির তৈরি করা হয় বা নান রুটি চুলায় ঢুকানো হয় সেটাও খেয়াল করে দেখে। এক সময় সে অনুরোধ করে নানের চুলায় নান দিয়ে নান তৈরি করতে। প্রথম কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শুধুই ব্যর্থতা নয়। তার হাতে যে পশম ছিল সব পুড়ে যায় তার এই নানের চুলায় নান লাগাতে গিয়ে। এমনকি চোখের উপর লম্বা কালো ভ্রুর অর্ধেকটা পুড়ে যায় তার। তাতেও মিতুল হাল ছাড়ে না। শেষ পর্যন্ত সে নান রুটি নানের চুলায় দিতে সফল হয়। প্রথম বারেই তার তৈরি করা নান গোল এবং বেশ সুন্দর হয়। ফোলেও ভালো।
রেস্টুরেন্টে স্টাফদের জন্য দুই বেলা খাবার ফ্রি তাই স্টাফদের দুপুরের কারি এবং রাতের জন্য আলাদা খাবার তৈরি করা হয়। এক সময় মিতুল ম্যানেজারকে বলল আমি নিজে নিজের রান্না করে খাবো। এতে ম্যানেজার মোটেও বাঁধা দেননি মিতুলকে। মাঝে মধ্যে সে বাইরে থেকে নিজের পছন্দের সবজি কিনে এনে নিজের খাবার জন্য রান্না করে। এভাবে আস্তে আস্তে রান্না করার কাজে অনেকটা পারদর্শী হয়ে উঠে মিতুল। এতে সে মোটেও ক্ষ্যান্ত হয়নি। রেস্টুরেন্টে গেষ্টদের জন্য যখন খাবার রান্না করা হয় তখন প্রধান বাবুর্চীকে বলে তার পাশে দাঁড়িয়ে কারি নাড়া দিয়ে কারি রান্না করা শুরু করে। এভাবে সে একসময় কারি রান্না করাও পুরো শিখে যায়।
রেস্টুরেন্টে প্রধান বাবুর্চীর বাইরে কিচেনে অন্য কেউ-ই রান্নার কাজে হাত দেবার নিয়ম নেই। এমনকি ম্যানেজার নিজেও যায় না কিচেনে কখনো। কিন্তু মিতুলের বেলায় কারো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাঁধা বা আপত্তি না আসায় সে খুব সহজে পুরো রান্নার কাজ শিখে যায় অল্প কয়দিনে। মিতুলের কাজে এমন আগ্রহ দেখে মালিক পক্ষ সিদ্ধান্ত নেন তাকে দিয়ে কোম্পানীর অন্য ব্রাঞ্চের নাইট সিফট চালানোর ব্যবস্থা করবেন। যখন সবাইকে নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের এমন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করলেন তখন থেকে কেউ যেন আর মিতুলকে মানতে বা সহ্য করতে পারছিল না।
এক সময় সে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের চাকরি ছেড়ে দেয়। শুরু হয় তার কাজ খোঁজা। ভালো ভালো কাজের প্রস্তাব আসলেও সব কাজই টোকিওর বাইরে। কিন্তু কোনো ভাবে সে টোকিওর বাইরে যেতে আগ্রহী নয়। মিতুলের কথা, বেতন সে যাই পাক, টোকিওতে থাকা চাই। যে জন্য টোকিওতে যে কোনো রেস্টুরেন্টে থালাবাটি ধোয়ার কাজ হলেও সে করতে চায়। বেশি বেতনে ভারী কোনো কাজ করার পক্ষে নয় সে।
একদিন মিতুলের পরিচিত এক বাংলাদেশি বাবুর্চী রিফাত তার বাসায় ফোন করে তাকে সুবিধা মতো দিনে দেখা করতে বলে তার ঠিকানা দিয়ে দেন। মিতুলকে ফোন করে বলা হয় তার জন্য ভালো একটি কাজের অফার আছে তাই কাল বিলম্ব না করে যেন চলে আসে। তাই মিতুল কাজের জন্য চলে যায় সেই বাবুর্চীর রেস্টুরেন্টের ঠিকানায়। কথা হয় তাদের। মিতুলকে বললেন, টোকিওতেই একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট নিউ ওপেন করা হচ্ছে। সেখানে রান্না জানা ওয়ালা লোক দরকার। তার যদি কাজ করার আগ্রহ থাকে তাহলে জানাতে বললেন। আরো বলা হলো, থাকা খাওয়া সহ মাসে দেড় হাজার ইউ এস ডলার বেতন ফিক্সড। ছুটি হবে সোমবার। সেদিন রেস্টুরেন্ট পুরো বন্ধ রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। স্থান, টোকিওর কাৎস্যুশমিকা ওয়ার্ডের শিবামাতা শহরে।
শিবামাতা জায়গার নাম শুনেই মিতুল রাজি হয়। এটি টোকিওর মধ্যে বেশ একটি পরিচিত নাম। জাপানের একজন খ্যাতিমান টিভি অভিনেতা এই এলাকায় জন্মেছেন, তার উপর এই এলাকায় জাপানি ভাষায় অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে, যে কারণে বেশ পরিচিত এই শিবামাতা। এলাকার নাম শুনেই মিতুল আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি। বলল, আমি এই এলাকায় প্রতিদিন আসা যাওয়া করতে পারবো এটাই আমার আগ্রহের মূল কারণ। বলে তখনই কাজ করার সম্মতি দিয়ে বলল, রেস্টুরেন্টের শুরুর দিন থেকে সে কাজ করবে। তাকে পরে যেন বিস্তারিত জানানো হয়।
শিবামাতা শহরে যখন নতুন রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করার সবকিছু ফাইনাল করা হয় তখন মিতুলকে ডাকে সেই রেস্টুরেন্ট দেখার জন্য। পাশাপাশি সে যেহেতু রেস্টুরেন্টের মূল দ্বায়িত্বে থাকবে তাই বলা হয় এক সপ্তাহ আগেই তাকে কাজে যোগদান করে সবকিছু দেখে বুঝে নিয়ে তার নিজের মতো করে সাজাতে। মিতুল তাই করলো। মিতুল সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে উদ্বোধন করতে যা কিছু প্রয়োজন এবং তার কিচেনের ভিতর প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে সব কিছুর লিস্ট করে বাকি যা কিছু কেনা দরকার তা কিনে আনতে অনুরোধ করে।
জাপানে যেহেতু শনি-রবিবার সপ্তাহে দুই দিন ছুটি থাকে তাই কোনো এক শনিবার রেস্টুরেন্ট আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ঘোষণা দিয়ে পরিচিতদের টেলিফোন করে দাওয়াত দিতে থাকেন মালিক পক্ষ। শুক্রবার সারাদিন রান্নার আয়োজন করে মিতুল। তার সাথে আরো দু'জনকে সহযোগিতা করার জন্য নেয়া হয়। তারা সবাই মিলে পরেরদিনের জন্য খাবার তৈরি করে। পুরো প্রস্তুতি শেষ করে রাতে বাসায় চলে আসে মিতুল।
পরেরদিন খুব সকাল সকাল মিতুল চলে যায় শিবামাতা স্টেশনের পাশেই নতুন রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করতে। রেস্টুরেন্টের নাম রাখা হয় "আনন্দ"। রেস্টুরেন্টের সামনে যেতেই দেখে গেইটের সাথে অনেক গুলো বড় বড় ফুলের তোড়া লোহার রড দিয়ে তৈরি করা ফুল রাখার স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। দুই পাশে তার দুইটি বিশাল বড় ছবি। লেখা রয়েছে প্রধান বাবুর্চী মিতুল। সে তার এই বাবুর্চীর পোশাকে এত বড় তার সমান উচ্চতার হার্ড বোর্ডে বাঁধাই করা ছবি দেখে নতুন করে কাজের উৎসাহ পায় মনে। সে তার নিজের ছবি রেস্টুরেন্টের সামনে সাজিয়ে রাখতে দেখে ভাবে, এই রেস্টুরেন্টই তাকে জাপানে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিবে। সুতরাং তাকে এই রেস্টুেরন্টের জন্য পরিশ্রম করতেই হবে। তবেই সে তার নতুন পেশায় প্রতিষ্ঠা পাবে। সবাই তাকে চিনবে বাবুর্চী হিসেবে। নাম হবে তার মিতুল বাবুর্চী।
এরপর গেইট ঠেলে রেস্টুরেন্টের ভিতর প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবেশ করেই সে দেখে তার আসার আগেই কাজ অনেকটা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই বেশ একটিভ। তাড়াতাড়ি করে সে তার ড্রেস পরিবর্তন করে কিচেনের সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে বাইরে হলে যায় উদ্বোধনী নিয়ে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করতে। মালিক পক্ষ মিতুলকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলে। এসময় স্থানীয় মিডিয়ার কয়েকজন সাংবাদিক আসেন। তাদের সাথে মিতুলকে মালিক পক্ষ পরিচয় করিয়ে দেন। মিডিয়া কর্মীরা তার সাক্ষাৎকার নিয়ে ছবি তুলে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই রেস্টুরেন্ট এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
(চলবে)
লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক