ফিচার ডেস্ক: গ্রাম হলো বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল পটভূমি। গ্রামীণ জীবনপ্রণালী, শস্য উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, চিত্তবিনোদন ইত্যাদির প্রাণবন্ত ও প্রকৃতিক রূপ আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ভাণ্ডারে রয়েছে-
নকশিকাঁথা: যুগ যুগ ধরে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নকশিকাঁথা। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা এখন স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে।
শখের হাঁড়ি: রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া এবং নওগাঁর বাঙাল পাড়ার শখের হাঁড়ির কদর রয়েছে। অঞ্চলভেদে এ দু’টি স্থানের শখের হাঁড়ির শিল্পকৌশল আলাদা।
পুতুল: হাতে তৈরি মাটির টেপা পুতুল, কাপড়ের পুতুল, কাঠ, পাট ও শোলার বিভিন্ন পুতুল আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
তাঁত: দেশজ জামদানি ছাড়াও খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে ঢাকার মসলিন রোমে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেসময় এখানকার তাঁতীরা বিভিন্ন ধরনের মসলিন তৈরি করতেন।
এগুলোর মধ্যে তানজেব, সারবন্দ, বাদান, খোশ, এলেবেলে, তারাঙ্গম, কুমিশ, তূর্য, ননসুখ, মলমল, জামদানি ও আদ্দি অন্যতম। মসলিন ছাড়াও বাংলাদেশে অন্যান্য মিহি সুতার কাপড় তৈরি হয়। এগুলোর মধ্যে শবনম ও আবে রাওয়াঁ উল্লেখযোগ্য।
পাটজাত পণ্য: পাটের তৈরি বিভিন্ন রকমের সিকা, শতরঞ্জি, কার্পেট, সৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি সৌখিন পণ্যরূপে সমাদর পাচ্ছে।
নকশি পাখা: নকশি পাখার মূল উপকরণ সুতা, বাঁশ, বেত, খেজুরপাতা, শোলা, তালপাতা ইত্যাদি। আগে এখানে ময়ূরের পালক ও চন্দন কাঠের পাখাও তৈরি হতো। নকশা অনুযায়ী এসব পাখার নামও রয়েছে। যেমন- শঙ্খলতা, গুয়াপাতা, পালংপোষ, কাঞ্চনমালা, ছিটাফুল, তারাফুল, মনবিলাসী, মনবাহার, বাঘবন্দি, ষোলকুড়ির ঘর, মনসুন্দরী, সাগরদীঘি ইত্যাদি।
শীতলপাটি: বেত গাছের ছাল থেকে তৈরি হয় শীতলপাটি। নকশা করা শীতলপাটিকে নকশিপাটিও বলে। সিলেট এই পাটির জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরও শীতলপাটি তৈরিতে বিখ্যাত।
বাঁশ ও বেত: কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকায় বাঁশ ও বেত দিয়ে বেড়া, চাটাই, মাছধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, ফুলদানি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি হয়।
কাঁসা ও পিতল: ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরিয়তপুরে বংশ পরম্পরায় তৈরি হয়ে আসছে এসব জিনিস।
আলপনা ও পিঁড়িচিত্র: পূজা, অন্নপ্রাসন, বিয়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রাঙ্গণ, দেয়াল, কুলা, ডালা ইত্যাদিতে আলপনা দেওয়া হয়। পিঁড়িচিত্রও থাকে এসময়।
পটচিত্র: প্রাথমিক পর্যায়ে পটচিত্রের বিষয় ছিলো পৌরাণিক-ধর্মীয় কাহিনী। কারণ, কালীঘাটে তীর্থযাত্রীরা মহান এ যাত্রার প্রতীক হিসেবে এটি নিয়ে যেতেন।
নকশি পিঠা: বাঙালির লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলির গুরুত্ব অনেক। এটি লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই একটি অংশ।
পালাগান: পালাগানে ধরা পড়ে সমাজের বাস্তব চিত্র। পালাগানের মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে বীরত্ব, ন্যায়নীতি ও কাল্পনিক চরিত্রগুলোও।
লোককাহিনী ও লোকনাট্য: ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে প্রভৃতি ছাড়াও ধাঁধামূলক ও নীতিকথামূলক গল্পই লোককাহিনী। এসব লোককথা, রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি ও লোকপুরাণ মিলে লোককাহিনীর বিশাল ভাণ্ডার থেকেই তৈরি হয় লোকনাট্য।
পুতুল নাচ: গ্রামবাংলার অন্যতম বিনোদনের আকর্ষণ ছিলো পুতুল নাচ। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে পুতুল নাচ হতো। তবে বর্তমানে বাঙালি ঐতিহ্যের এই অংশটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
লোকসঙ্গীত: অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত ধরনের লোকসঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা. কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা, গীত প্রভৃতি।
খনার বচন:খনার বচন যুগ-যুগান্তর ধরে গ্রাম বাংলার জন জীবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া।
ঐতিহ্যবাহী খেলা: হাডুডু, নৌকা বাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর উড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি।
ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন ও ধাঁধাঁ: কোনো কাজে উৎসাহ বাড়াতে ও চিত্তবিনোদনের জন্য অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মুখে মুখে ছড়া তৈরি হতো। এছাড়াও বায়োস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে ছবির বর্ণনা দেওয়া হয়। ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো প্রবাদ-প্রবচন। প্রবাদ-প্রবচন লোক-পরম্পরাগত বিশেষ উক্তি বা কথন।
সাননিউজ/এএসএম