সান নিউজ ডেস্ক: ‘বিরুলিয়া’ তুরাগ নদীর তীরবর্তী ছোট্ট একটি গ্রাম। তবে গ্রামটি ঐতিহ্য স্থাপনার জন্য সুপরিচিত। গ্রামের শেষ প্রান্তে অবস্থিত জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের বাড়ি।
জনশ্রুতি মতে, অতীতে বিভিন্ন স্থানে রজনীকান্তের সম্পত্তি থাকলেও বর্তমানে আছে শুধু বিরুলিয়া গ্রামের এই বাড়ি খানা। সে সময় আরেক জমিদার নলিনী মোহন সাহার কাছ থেকে ৮হাজার ৯৬০ টাকা ৪ আনি’র বিনিময়ে বাড়িটি কিনেছিলেন জমিদার রজনীকান্ত।
ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর থেকে বিরুলিয়াগামী বাসে করে বিরুলিয়া নামার পর যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জমিদার বাড়ির ঠিকানা মিলবে। চাইলে প্রাইভেটেও আসা যাবে সহজে। আব্দুল্লাহপুর, বাইপাইল কিংবা আশুলিয়া হয়েও আসা যাবে।
আমরা বিরুলিয়া পৌছে গেলাম অল্প সময়ের মধ্যে। ছিমছাম নিভৃত পল্লী। মন জুড়ানো শীতল বাতাস আর নানা পাখির ডাকে মুখরিত নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যের দেবী যেন মনে হলো এই লোকালয়কে।
সাভারের বিরুলিয়া ব্রীজের পরেই বাম পাশের সরু লম্বা কালভার্ট তারপরেই এই এলাকা শুরু। লাল ইট বিছানো পথ ধরে গ্রামের শেষ প্রান্তে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের বাড়ি। সকরুণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর ভবনগুলো।
এসব পুরাকীর্তি দেখে ভাবনায় আসলো-এখানেই রাণী ‘মা’ মুক্তছাদে বসে দাসীদের নিয়ে তুরাগের সৌন্দর্য্য দেখতেন। মসলায় সাজানো পান খেতেন। দাসীরা চুলে রাজকরভী তেল লাগিয়ে দিতো আর তিনি দূর থেকে পাল তোলা বড় বজরার বহর দেখে বলতেন -এই রাজামশাই এসে গেছেরে, তোরা তাড়াতাড়ি নীচে নাম!
এভাবে নস্টালজিক ভাবনা নিয়ে আরেকটু সামনে এগোতেই বিরুলিয়া ঘাট। ঘাটের পারে গায়ের মুরুব্বিরা আয়েশ করে বিকেলের হাওয়ায় মেতে উঠেছেন খোশগল্পে।
জমিদার বাড়িতে সদরঘর, বিশ্রামাগার, বিচারঘর, পেয়াদাঘর, ঘোড়াশালাসহ রয়েছে অন্যান্য মিলনায়তন ও হলরুম।
ঘাটে এসে দেড়'শ টাকায় ভাড়া করা নৌকায় উঠেই চললাম ‘মা’ যশাই মন্দির দেখতে। মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব মাত্র। জায়গাটা আস্ত একটা দ্বীপের মতো। চারদিকে থৈ থৈ পানি। মাঝখানে ত্রিকালজ্ঞ চারটি বটগাছের সাথে লাগোয়া এই মন্দিরটি। চারদিকে পোড়া ইট দিয়ে বাধানো। জরার্জীণ বাধানো ঘাটটি দেখলে সেই সময়কার জৌলুশ এখনো মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখানে নেমেই ঠান্ডা শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে গেল আমাদের। ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম আরো উপরে। পাখির কলতানে মুগ্ধ হলাম।
মন্দিরের ছায়াঘেরা পূর্বকোণ থেকে দেখলাম বেশ কয়েকটি বালু পরিবহনকারী নৌযান। বিশ্রী রকম ভটভট শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা দেখার ইচ্ছে থাকলেও দেখা হলোনা। কালের বিবর্তনে জমিদার রজনীকান্ত বাবুর মতো এসবও যেন বিলীন হওয়ার উপক্রম।
চারদিকে পানি বেষ্টিত বিরুলিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় এখুনি এগিয়ে না এলে হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যাবে জমিদার বাড়িটি। বিলুপ্তি ঘটবে নিভৃতেই।
বেলা শেষে এবার ফেরার পালা। আবার ঘাটে আসলাম। সেখানে বটগাছের নীচে ছোট একটি মুদি দোকান। একজন অশীতিপর বৃদ্ধ বসে আছেন। মনযোগ দিয়ে শুনছেন দোকান থেকে ভেসে আসা মুজিব পরদেশীর একটি গান-'মন তোরে পারলাম না বুঝাইতে রে...''
মনকে আমিও বুঝালাম এখান থেকে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু কাজ হলোনা। আবার ছুটলাম শহুরে কোলাহলের দিকে। বিশ্রী বাস্তবতা তাড়া করছে.....
লেখক : হাফিজুর রহমান রিয়েল
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
সান নিউজ/এমএম