সান নিউজ ডেস্ক: বুদ্ধের জন্মের আগে তাঁর মা সাদা হাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। কুলপুরোহিত তাঁর স্বপ্নটি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন স্বপ্নে সাদা হাতি দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের প্রতীক। পরে তিনি বুদ্ধকে প্রসব করেন। সে সময় শুদ্ধ, সাত্ত্বিক ভাবের রূপক হিসেবে ধরা হত হাতিকে।
কিন্তু এ তো গেল মিথের ব্যাখ্যা, হাতিকে শুভ প্রতীক ধরার গল্প।কিন্তু সব জায়গায় একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে হাতিকে দেখা হত না। এক একটা সংস্কৃতিতে এক এক রকম ভাবে দেখা হয়েছে। হাতির বুদ্ধি যেমন সাংঘাতিক, তেমনই হাতির শক্তি অতুলনীয়।
ফলে হাতিকে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হত কোথাও কোথাও। হাতি সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত। এমনকি পরবর্তীকালে জমিদাররাও হাতিকে সামন্ততান্ত্রিক শক্তির প্রতীক হিসেবে পালন করত।
এ সবের বাইরে হাতিকে মানুষ হত্যার কাজেও ব্যাবহার করা হত। ভারতের ইতিহাসে ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত হাতি দিয়ে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হত। সেখানে চোর, বিদ্রোহী, খুনি – এদের সকলকে শাস্তি দিতে হাতির পায়ের তলায় ফেলে দেওয়া হত, যাতে হাতিটি তাদের পিষে ফেলতে পারে। শুধু অসামরিক দোষীদের নয়, সামরিক বাহিনীর শত্রুদেরও হাতির পায়ের নিচে ফেলে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
কেবল পায়ের নিচে অতর্কিতে ফেলা দেওয়াই হত, এমন নয়। হাতিকে রীতিমতো ট্রেনিং দিয়ে এই কাজ করানোর প্রথা ছিল। কোনো মানুষকে পুরোপুরি মারার আগে শরীরের প্রত্যঙ্গগুলোকে ছিঁড়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত হাতিদের। ধাপে ধাপে মানুষকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলতে পারত হাতি। যেহেতু হাতিকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে মনে করা হত, সেহেতু হাতি দিয়েই সে কালের রাজা, মহারাজারা জল্লাদের কাজটা করিয়ে নিতেন।
হাতির সাহায্যে মানুষকে মেরে ফেলার এই পদ্ধতিকে গুঙ্গা রাও পদ্ধতি বলা হত। ভারতে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত এভাবে শাস্তি দেওয়ার চল ছিল। শুধু ভারত নয়, মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই পদ্ধতির ব্যবহার ছিল। যদিও পদ্ধতিটি ছড়িয়ে পড়েছিল পাশ্চাত্যের নানা দেশেও।
যেমন ‘হিসতোরিয়েই আলেকজান্দ্রি মাগ্নি’-তে রোমান ঐতিহাসিক কুইনটাস রিফিউস কার্টিউস লিখেছিলেন, আলেকজেন্ডারের মৃত্যুর পরে আয়োজিত প্রথম সমাবেশে ৩০ জন সৈনিককে পেরেইডিকাস হাতির সামনে ফেলে দিয়েছিলেন। হাতিরা তাদের পায়ের নিচে পিষে মেরে ফেলেছিল।
বাঘ, সিংহ, সাপ, কুমীরের পরিবর্তে হাতিকে এই কাজের জন্য বেছে নেওয়াতে বোঝা যায়, হাতির মধ্যে কিছু বিশেষ গুণ লক্ষ করা গেছিল। হাতিকে শেখানো সম্ভব ছিল মানুষের মাথা ফাটানোর আগে হাত-পা ভাঙা দরকার। হাতি সেটা সহজেই আয়ত্ব করে ফেলত। ফলে মৃত্যুর নৃশংসতাকে কমানো বা বাড়ানো যেত সহজেই। হাতি কেবল আদেশ অনুযায়ী কাজ করত।
মুঘল আমলে ভারতে হাতিকে অদ্ভুত ভাবে ব্যবহার করা হত। ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ার দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, দিল্লিতে কীভাবে হাতির সাহায্যে মানুষকে হত্যা করা হত। তিনি এক রকম ব্লেডের কথা লিখে গেছেন। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী হাতির শরীরে লাগানো থাকত ব্লেড।
সেই ধারালো ব্লেডের মাধ্যমে অপরাধীর সারা শরীর টুকরো টুকরো করে দেওয়া হত। ব্রিটিশরাজ শুরু হওয়ার পরে হাতির এরকম ব্যবহার কমে যায়। কেননা, ভিক্টোরীয় ভাবনায় লালিত ইংরেজরা মনে করতেন এর চেয়ে নৃশংস মৃত্যু আর কিছু হয় না। মানবিকতার খাতিরেই হাতির পায়ের নিচে অপরাধীদের ফেলে দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে জল্লাদের ভূমিকায় হাতিকে ব্যবহার করার নমুনা পাওয়া যায়। যেমন, সিয়াম রাজ্যে (আজকের থাইল্যান্ডে) হাতির পায়ের নিচে পিষে দেওয়ার আগে শেখানো হত, অপরাধীকে টস করে উপর দিকে ছুঁড়ে দিতে। নিচে পড়লে তারপর পা-দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হত।
অন্যদিকে, কোচিনচিনা রাজ্যে (বর্তমানে ভিয়েতনামে) অপরাধীদের বেঁধে রেখে, তার উপর একটি হাতিকে চাপিয়ে দেওয়া হত। আবার, শ্রীলঙ্কায়, প্রথমে ছুরি দিয়ে অপরাধীকে ফালা ফালা করে তারপরে তার শরীরের টুকরোকে সাজাতে শেখানো হত।
মৃত্যুদণ্ডের এই পদ্ধতিটি নির্মম এবং ভয়ঙ্কর ছিল। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে পশুদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার ছিল। মিথের মধ্যে থাকা পশুদের প্রতীক-রূপক গুলো ব্যাখ্যা করলে সব সময়ই শুভ এবং অশুভ দুইভাবেই তাদের দেখতে পাওয়া যাবে।
সান নিউজ/এমএম