ফিচার ডেস্ক: মিশরের শহরকে বলা হয় পিরামিডের শহর। রহস্যমণ্ডিত সপ্তাশ্চর্য মিশরের এই পিরামিড। প্রাচীন সত্যতার সূতিকাগার মিশরের পরতে পরতে রহস্যজালে আবৃত। মিশরীয়দের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে হাজার হাজার বছর আগে করা মমি পদ্ধতি যেমন বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে। তেমনই পিরামিড রহস্য গবেষকদের কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ করেছে।
গিজার গ্রেট পিরামিড নিয়ে বিশ্ববাসীর জানার আগ্রহ তুঙ্গে। তখনকার সময়ে উঁচু এসব পিরামিড তৈরি করা এতোটাও সহজ ছিল না। পিরামিড রহস্য যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানী কিংবা গবেষকরা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পিরামিডের নাম শুনলেই নিশ্চয় মনে পড়ে মমি, নীলনদ, আর বড় বড় মূর্তির কথা।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা কাপড় ও মাথায় অদ্ভূত মুকুট কিংবা কাপড় পরা ব্যক্তিদেরকে। তবে সেসব কিছু ছাপিয়ে বিশ্ববাসীর সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা মিশরের পিরামিড নিয়ে। যার রহস্য হাজারো বছর পেরিয়ে এসে আজো ধোঁয়াশা।
মিশরের পিরামিডের রহস্য আজো ধোঁয়াশা
পিরামিডের বিশালত্ব আপনাকেও অবাক করবে। মিশরের সবচেয়ে বড়, পুরোনো এবং আকর্ষণীয় পিরামিড হচ্ছে গিজা’র পিরামিড যা খুফু’র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। এর নির্মাণ নিয়ে যেমন রয়েছে যুক্তিও তর্ক, তেমনি এর স্থায়িত্ব নিয়েও রয়েছে নানান রহস্য। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে পিরামিডের ভেতরের তাপমাত্রা।
গ্রেট পিরামিড ৩ হাজার ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মানব-নির্মিত কাঠামো ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫০ সালে নির্মিত এই পিরামিড বিশ্বের সাত প্রাগৈতিহাসিক আশ্চর্যের একটি। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। পিরামিডটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক এক লাখ।
পিরামিডটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক এক লাখ
পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খণ্ড দিয়ে। পাথর খণ্ডের একেকটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মতো। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সঙ্গে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হত।
৪ হাজারের বছরের পুরোনো এক সমাধিতে আঁকা চিত্রে দেখা যায়, বিশাল স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে। অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে পানি ঢালছে বালির উপরে। এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়াই টন ওজনের একেকটি ব্লক।
পিরামিডে ফেরাউন সহ আরো অনেক ফারাওয়ের মমি রয়েছে
বিশ্বে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া একমাত্র আট পার্শ্বযুক্ত পিরামিড এটি। গিজার গ্রেট পিরামিডের চার পার্শ্ব সামান্য অবতল। যে কারণে এই পিরামিডের কেন্দ্রটি অসাধারণ একটি কৌণিক অবস্থান সৃষ্টি করেছে। যা বিশ্বের একমাত্র আট পার্শ্বযুক্ত পিরামিডের জন্ম দিয়েছে।
যদিও এই অসাধারণ নির্মাণকৌশল ভূমি থেকে বা দূর থেকে দেখলেও বোঝা যায় না। শুধু বছরের বিশেষ একটি সময়ে উপর থেকে দেখলে টের পাওয়া যায়। শরৎ ও বসন্তকালে ভোরে এবং সূর্যাস্তের আলোয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলার দৃশ্যের দেখা মেলে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, গবেষকরা ৫-৬ বছর আগে খুঁজে পেয়েছে গিজার দ্য গ্রেট পিরামিডের মধ্যকার তাপমাত্রার তারতম্য থাকার কারণ। থার্মাল ক্যামেরা দিয়ে গুপ্ত কুঠুরি খুঁজতে গিয়ে গিজার পিরামিডের কয়েকটি স্থানের পাথরে তাপের তারতম্য পর্যবেক্ষণ করেছেন স্থপতি আর বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল।
মমি তৈরির রহস্য বিশ্বের নামীদামী গবেষকদের কপালের ভাঁজও দীর্ঘ করেছে
গবেষণায় দেখা গেছে, গিজার গ্রেট পিরামিডের ভেতর উষ্ণ এবং অপেক্ষাকৃত শীতল দুটি স্থান রয়েছে। যেখানকার তাপমাত্রা বলেতে গেলে সবসময় প্রায় একইরকম থাকে। গবেষকরা ধারণা করেন, হাজার বছর ধরেই এই তাপমাত্রা ধরে রেখেছে পিরামিডটি।
পিরামিডের ভেতরের তাপমাত্রা সারা বছরই ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। তবে দিন ও রাতের ব্যবধানে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটতে পারে।
পিরামিডের ভেতর লুকোনো কোনো স্থাপনা আছে কি-না, তা পরীক্ষা করতেই বিজ্ঞানীরা আধুনিক ইনফ্রারেড এবং থ্রিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করছিলেন। ইনফ্রারেড থার্মোগ্রাফি পরীক্ষায় পিরামিডের ভেতরে বেশকিছু অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। পরীক্ষার পর দেখা যায়, পিরামিডের মধ্যকার তাপমাত্রা উঠানামা করে না, বলতে গেলে সবসময় একই রকম থাকে।
অদ্ভুতভাবে পিরামিডের অন্যপাশে এই পরিবেশ দেখা যায় না। যদিও কি কারণে বা কীভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের এমন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল প্রাচীন মিশরীয়রা তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।
মমির সঙ্গে রাখা হয়েছে আসবাবপত্র, শস্য, দামী রত্ন
প্রাচীন মিশরে নির্মিত সব পিরামিড নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। মিশরীয়দের ধারণা সূর্য পশ্চিমে মৃত রাজাদের সম্মান জানিয়ে অস্ত যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম বরাবর প্রায় নিখুঁতভাবে এই পিরামিড বসানোর পেছনে আছে দারুণ সহজ একটি কৌশল। গিজা পিরামিড নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন প্রকৌশলী গ্লেন ড্যাশ।
গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছেন, ফল ইকুইনক্স বা শারদ বিষুবকে ব্যবহার করে এত নিখুঁত হিসাব করে মিশরীয়রা। এই হিসাবের ফলাফল হিসেবে পিরামিডের চারটি কোণ উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে প্রায় নিখুঁতভাবে অবস্থান করছে।
পিরামিডের ভেতরে একেক জায়গায় একেক রকম তাপমাত্রা
তবে কেন পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল তাও অনেক বড় প্রশ্ন। এর পেছনেও রয়েছে নানান যুক্তি তর্ক। পিরামিডের ভেতরে মিশরের ফারাও এবং রাজবংশের অনেকের মমি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, মমি সংরক্ষণের জন্যই তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। ভাবছেন মমি সংরক্ষণের জন্য এতো বিশাল আয়োজনের কি দরকার ছিল? অন্যভাবেও তো সংরক্ষণ করা যেত।
প্রাচীনকালে মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মানুষ মারা গেলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না বরং এরপরও জীবন আছে। এজন্য মিশরের ফারাওরা মারা গেলে তাদের বংশধরেরা মৃত্যুর পর যাতে তাদের কোনো কষ্ট বা অসুবিধা না হয় তার জন্য তাদের দেহকে মমি করে পিরামিডে রাখত।
পিরামিডের ভেতরে রয়েছে অনেক গুপ্ত ঘর, যা আজো ঘোলা সম্ভব হয়নি
এছাড়া মমির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য-দ্রব্য, মূল্যবান অলংকার, দেবতাদের মূর্তি, পোষা প্রাণী বা পাখিও মমি করে দিত। মমির তত্ত্বাবধানের জন্য লোক নিয়োজিত থাকত। ধারণা করা হয়, পিরামিড ফারাওদের মমি সংরক্ষণের জন্যই তৈরি হয়ে থাকতে পারে। তবে এর ভেতরে রয়েছে অনেক কক্ষ। কেন এত কক্ষের প্রয়োজন ছিল সে সম্পর্কেও আজো জানতে পারেনি গবেষকরা।
সাননিউজ/এএসএম