আহমেদ রাজু
২৮ প্রকারের মসলিন হতো ঢাকায়। মলবুস খাস ছিলো সবচেয়ে দামি। জামদানি নামে এক প্রকারের মসলিন এখনো বিপুল প্রচলিত। নানা কারণে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে যায়। কিছু প্রসিদ্ধ মসলিন সম্পর্কে জেনে নিই।
মলবুস খাস
মলবুস খাস ছিলো বাদশাহ বা সম্রাটদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি মসলিন। মলবুস খাস মানে আসল কাপড়। ১৮ শতকের শেষের দিকে মলবুস খাসের মতো আরও একটি উন্নত কাপড় ছিলো। নাম মলমল খাস। দের্ঘ ছিলো ১০ গজ ও প্রস্থে ১ গজ। ওজন হতো ৬ থেকে ৭ তোলা। একটি আংটির মাঝখান দিয়ে অনায়াসে আনা নেওয়া করা যেতো। এই কাপড়গুলো রপ্তানি হতো ।
সরকার-ই-আলা
মলবুস খাসের মতো মসলিনের এই কাপড়টিও ছিলো বেশ উন্নত । বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হতো সরকার- ই- আলা মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হতো বলে এই দেয়া হয়েছিলো। লম্বায় ১০ গজ ও চওড়ায় ১ গজ। ওজন হতো প্রায় ১০ তোলা।
ঝুনা
জেমস টেলরের মতে, ঝুনা শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ঝিনা থেকে। অর্থ— সূক্ষ্ণ কাপড়। ঝুনা মসলিন সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো। সুতার পরিমাণ থাকতো কম। এ মসলিন দেখতে ছিলো হালকা জালের মতো। এক টুকরো ঝুনা মসলিন লম্বায় ছিলো ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা।
এটি পাঠানো হতো মুঘল রাজ দরবারে। শাহাজাদা ও হারেমের মহিলারা গরমকালে ব্যবহার করতো এই মসলিনের তৈরি জামা। হেরেমের বাইজিরা ঝুনার তৈরি জামা পরে নাচ করতেন।
আব-ই-রওয়ান
আব-ই-রওয়ান ফার্সি শব্দ। অর্থ—প্রবাহিত পানি। এই মসলিন ছিলো অত্যন্ত সুক্ষ্ম। প্রবাহিত পানির মতো টলটলে। উপমা বোঝাতে নাম দেয়া হয় ‘আব-রওয়ান’। লম্বায় ছিলো ২০ গজ, চওড়া ১ গজ। ওজন হতো ২০ তোলা।
খাসসা
ফার্সি শব্দ খাসসা। এই মসলিন কাপড় ছিলো মিহি ও সূক্ষ্ম। বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁও বিখ্যাত ছিলো খাসসা মসলিনের জন্য। তাছাড়া ১৮ ও ১৯ শতকে জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। একে ‘জঙ্গল খাসসা’ বলা হতো। ইংরেজরা বলতো ‘কুষা’।
শবনম
শবনম অর্থ—ভোরের শিশির। ভোরে শবনম মসলিন শিশিরভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হতো বলে , এই মসলিন দেখাই যেত না। এতটাই মিহি ও সূক্ষ্ম ছিলো শবনম। ২০ গজ লম্বা ও ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা।
নয়ন সুখ
এই মসলিনের নামটি নেয়া হয়েছিলো একমাত্র বাংলা শব্দ থেকে। সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে এর ব্যবহার হতো। এ জাতীয় মসলিনও ছিলো ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ চওড়া।
বদন খাস
বদন অর্থ—শরীর। খাস অর্থ—বিশে।নাম থেকে ধারণা করা হয়, সম্ভবত শুধু জামা তৈরির জন্য এ মসলিন ব্যবহার করা হতো। বদন খাসের বুনন ঘন হতো না। এই কাপড় ছিলো ২৪ গজ লম্বা ও দেড় গজ চওড়া। ওজন হতো ৩০ তোলা।
সর-বন্ধ
ফার্সি শব্দ সর-বন্ধ অর্থ—মাথা বাঁধা। সর-বন্ধ মসলিন কাপড় দিয়ে প্রাচীন বাংলার উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন। লম্বায় ছিলো ২০ থেকে ২৪ গজ। চওড়া ছিলো আধা থেকে এক গজ। ওজন হতো ৩০ তোলা।
ডোরিয়া
এই মসলিন ছিলো ডোরা কাটা। তাই এটি ‘ডোরিয়া’ বলে পরিচিত ছিলো। লম্বায় ছিলো ১০ থেকে ১২ গজ। চওড়ায় ১ গজ। শিশুদের জামা তৈরি করা হতো ডোরিয়া মসলিন দিয়ে।
জামদানি
আগেকার যুগে জামদানি বলতে বোঝাতো নকশা-করা মসলিনকে। ১৭শ শতকে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিলো। নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি ব্যবহার হতো।
এছাড়াও জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দাও তৈরি হতো। নেপোলিয়নের স্ত্রী সএী সম্রাজ্ঞী জোশেফিন তার শোবার ঘরে মসলিনের জামদানি পর্দা ব্যবহার করতেন।
উল্লিখিত মসলিন ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রকারের মসলিন ছিলো—রঙ্গ, আলিবালি, তরাদ্দাম, তনজেব, সরবুটি, ও চারকোনা।
হারিয়ে যাওয়া ঢাকাই মসলিনের ইতিহাস আজও আমাদের মনে দাগ কাটে। কারণ এই মসলিন আমাদের সোনালী ইতিহাস।
সান নিউজ/এমএইচ-৮