ফিচার ডেস্ক:
প্রতি বছরই ঘুরেফিরে বাঙালী জীবনে আসে উৎসবের পহেলা বৈশাখ। রংবেরঙের সাজে সেজে উঠে পুরো দেশ। ঢাক ডোল, গান আর নৃত্যের তালে ছন্দে আনন্দে মেতে উঠে বাঙালী মন।
অন্যসব দিনের মতো এবারও বাঙালীর জীবনে এলো পাণের মেলার এই দিনটি। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে ঘরে বসেই সবাই পালন করল এই দিনকে।
নাহলে বরাবরের মতো এবারও জমে উঠতো মঙ্গল শোভাযাত্রা। রমনার বটমূলে ভোর হতেই বেজে উঠতো ‘এসো হে বৈশাখ’। পাড়ায় পাড়ায় লাল-নীল-বেগুনী রংয়ের নাচন আর পিটা পুলির ধুম। ব্যবসায়ীদের সারা বছরের লেনদেন মিটিয়ে হালখাতার মিষ্টি বিতরণ এবার আর হয় করোনার জন্য। এ সবই বাঙালী ঐতিহ্যের হৃদয়ে লালন করা সুখ।
কিন্তু আমরা কি জানি কবে কোথা থেকে আসল এই কৃষ্টি । তাহলে চলুন জেনে নেই…
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। তবে হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত।
খাজনা আদায়ে সচ্ছতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।
সম্রাটের আদেশ মতে, রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম সৃষ্টি করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সবাই খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত।
এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা।
হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব স্থানেই পুরোনো লেনদেন চুকিয়ে পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানী মহাজনরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই প্রথাটি এখনো অনেকাংশে প্রচলিত রয়েছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
ইতিহাসবিদ শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম পুন্যাহ এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে ‘ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন’। তিনিই বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা করার লক্ষ্যে আকবরের রাজস্বের নীতি ব্যবহার করেন। একে বাংলা সন বা সাল বলা হত, যা যথাক্রমে আরবি ও ফারসি শব্দ। এটা নির্দেশ করছে যে, এটি প্রথম কোনো মুসলিম রাজা বা সুলতানের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে।
শামসুজ্জামান খান ও নীতিশ সেনগুপ্তের মতে, বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে সেনগুপ্তের মতে, এর ঐতিহ্যগত নাম হচ্ছে বঙ্গাব্দ । আর বঙ্গাব্দ শব্দটি আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বে দুটো শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের সময়ের পূর্বেও ছিল। আবার এও অস্পষ্ট যে আকবর বা হুসেন শাহ এর দ্বারা এটি গৃহীত হয়েছিল কিনা।
বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহারের রীতি আকবরের পূর্বে হুসেন শাহ এর দ্বারাই হয়ে থাকতে পারে। বাংলা দিনপঞ্জির প্রচলন যিনিই করে থাকুন না কেন, ঐতিহ্যবাহী বাংলা দিনপঞ্জির উপর ভিত্তি করেই বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর রাজস্ব আদায়ের জন্য এটা সহায়ক ছিল। কারণ ইসলামী হিজরি সনের ক্ষেত্রে রাজস্ব সংগ্রহের দিন ঠিক করতে প্রসাশনিক জটিলতা তৈরি হত।
বাংলা সনের উৎপত্তি
বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজিকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব প্রদান করেন।
বিখ্যাত পন্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত অথচ চাষবাস নির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর।
চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।
তারিখ-এ-এলাহীর বারো মাসের নাম ছিল কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ। কারো পক্ষে আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কখন এবং কীভাবে এসব নাম পরিবর্তীত হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র হয়।
অনুমান করা হয়, বারোটি নক্ষত্রের নাম নিয়ে পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় বাংলা মাসের। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।
ঐতিহাসিকদের মতে, পহেলা বৈশাখ উৎসবটি ঐতিহ্যগত হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত। যা ভাইশাখি ও অন্য নামে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই দিনে এই উৎসব পালিত হয়। হিন্দু ও শিখগণ এই উৎসব পালন করে। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নববর্ষের উৎসবগুলো হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে। ভারতের গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ে ভারতের অনেক অঞ্চল ও নেপালের মতো বিক্রমাদিত্যকে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাবের স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে সেই অঞ্চলগুলোর মতো বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি বরং ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল। মনে করা হয় শশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়।
বাংলাবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস
কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
নববর্ষ পালনের সংস্কৃতি
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। গ্রামাঞ্চলে বসে বৈশাখী মেলা। সেখানে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ারও ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন।
এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত। আর শহরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। পাশাপাশি থাকে নানা রকম খাবারের দোকান। নাগরদোলাসহ নানা আয়োজন। অনেক জায়গায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এভাবেই প্রতি বছর পালিত হচ্ছে আধুনিক বর্ষবরণ।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। অন্যান্য দেশে মূলত প্রবাসী বাঙালিরাই নিজেদের মতো করে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে এদিনটি। অনেকে মনে করেন পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। এখান থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করার আর কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায় এবং জাতি হয় ঐক্যবদ্ধ।
এবার নববর্ষ এসেছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ মহামারি হিসেবে দেখা দেয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারে আতঙ্কিত। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ঘরের বাইরে বের হওয়ার পথ হয়ে গেছে রুদ্ধ। এ কারণেই বাঙালিরা আজ ঘরে বসেই পালন করছে বাংলা নববর্ষের দিনটি। সূত্র: উইকিপিডিয়া।
সান নিউজ/সালি