নিজস্ব প্রতিনিধি, পাবনা : পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলায় ৪৩৯ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আজও স্ব মহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ৩ গম্বুজবিশিষ্ট শাহী মসজিদ। শাহী মসজিদটি বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে।
দেয়ালের ইট খসে যখন পুরোনো নিদর্শন আর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক সেসময় ১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করে মসজিদটি। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত মসজিদ। পাবনা-ভাঙ্গুড়া মহাসড়কে চাটমোহর শহরের ভাদুরহাট মোড় থেকে ১ কিলোমিটার দূরে সুলতানী মোঘল আমলের নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের ৪৩৯ বছরের মসজিদটি।
চাটমোহরের তিন গম্বুজ শাহী মসজিদের শিলালিপিতে এর নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্বন্ধে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। ওই শিলাফলকের ফার্সি লিপি থেকে জানা যায়, বিশাল এই মসজিদ, বিখ্যাত সুলতান সৈয়দ বংশীয় প্রধান সৈয়দ আবুল ফতে মুহাম্মদ মাসুম খানের সময় নির্মিত হয়।
কাকশাল গোত্রের সন্তান খান মুহাম্মদ তুকি খান ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। শিলালিপি পাঠ, অনুযায়ী অনুমান করা যায়, মাসুম খান নিজেকে সুলতানরূপে ঘোষণা করেন। তিনি নিজে এই উপাধি গ্রহণ করেন। কিছুকালের জন্য পাবনা অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং চাটমোহরে রাজধানী স্থাপন করেন।
ইতিহাসে জানা যায়, মাসুম খান ছিলেন সম্রাট আকবরের অনুজ মির্জা মুহম্মদ হাকিমের দুধ ভাই। মাসুম খান ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের কাকশাল গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। সম্রাট আকবর বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হলেও মাসুম খান কোনোদিনই আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেননি। পরে তিনি চাটমোহরে কিছু সময়ের জন্য একটি রাজ্য গড়ে তোলেন।
সম্রাট আকবর তার শাসনামলে দ্বীন-ই-ইলাহি নামে নতুন ধর্ম ঘোষণা করলে কাকশাল গোত্র এবং বাংলার মুসলমান ভুঁইয়ারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সী যুবক মাসুম খান কালা পাহাড় নামে সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীকৃতি স্বরূপ পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাপতি পদে দায়িত্ব পান। ১৫৭৯ সালে মাসুম খান বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বার ভূঁইয়াদের সঙ্গে যোগ দেন।
তিনি বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁনের সঙ্গে যোগ দিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১০০৭ হিজরি অথাৎ ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে সম্রাটের ফৌজি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন মাসুম খান। সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে চাটমোহরে স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালনার সময় ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে শাহী মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
চাটমোহরের শাহী মসজিদের দায়িত্বে রয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাইট পরিচারক মো. শাহজাহান আলী। তিনি ৩০ বছর ধরে এই শাহী মসজিদের দেখাশুনা করছেন। এছাড়া ওই মসজিদে একজন ঈমাম ও একজন মোয়াজ্জেম রয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাইট পরিচারক শাহজাহান আলী জানান, নথিপত্রে চাটমোহর শাহী মসজিদ মাসুম খাঁনের নামে পাওয়া গেলেও সুলতানী-মোঘল আমলের শাহী মসজিদ মনে করে সারাবছরে বহু মানুষ আসেন পাবনার চাটমোহরে। দেশ- বিদেশ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা আসেন একসাড়িতে ৩ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও এর কারুকাজ দেখতে।
ঢাকা থেকে কেউ মসজিদটি দেখতে আসতে চাইলে ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলরুটের চাটমোহর স্টেশনে নেমে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অটোরিকশা বা ভ্যানে চড়ে সহজে যেতে পারবেন। ঢাকা কমলাপুর থেকে সকালে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়ে চাটমোহরে পৌঁছাবেন দুপুরে, সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টা। চাটমোহরে ভালো মানের খাবার হোটেল রয়েছে।
দুপুর থেকে ঘুরে বিকেলে পদ্মা এক্সপ্রেসে চড়ে আবার ঢাকা ফিরে যেতে পারবেন। এছাড়া রাত্রীযাপন করতে চাইলেও চাটমোহর-পাবনা ঈশ্বরদীতে রয়েছে আধুনিক সব হোটেল-মোটেল। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের পাবনা প্রাচীন ও পুরাকীর্তির জনপদ।
সুলতানী-মোঘল আমলের বহু নিদর্শন পাবনা জেলায় রয়েছে। পুরোনো জেলা পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় যে সব প্রত্নতত্ত্ব মসজিদ ও নিদর্শনগুলো রয়েছে। তার মধ্যে শাহী মসজিদ অন্যতম। ৪৩৯ বছরের এই নিদর্শনটি যেন ইতিহাসে সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। যা কিনা যুগের পর যুগ থাকবে।
সান নিউজ/এসএ