লাইফস্টাইল ডেস্ক : গর্ভকালীন সময়টা হবু সব মায়ের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভের সন্তান সুস্থ থাকুক এটাই সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু এই শীতের মরসুমে তাদের প্রয়োজন কিছু বাড়তি যত্ন। শীতের প্রভাব যাতে মা এবং গর্ভের সন্তানের ওপর না পড়ে তার জন্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
কারণ এই সময়ে মায়েদের ঠান্ডা লাগলে, গর্ভের সন্তানটিও ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে পারে। যাঁদের আবার হাঁপানির রোগ আছে, তাঁদের ভোগার আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকটাই। জেনে নিন তাই এই শীতে কীভাবে মা ও শিশু উভয়ই সুস্থ থাকবেন। এই পরামর্শগুলো শুধু হবু মায়ের জন্যই নয়, আপনি যদি হবু বাবা হোন, এই পরামর্শগুলো আপনার জন্যও। সর্বোপরি এই পরামর্শগুলো আমাদের সবার জন্য!
আপনি কি হবু মা? যত্ন নিন শীতকালে
১. সুষম খাবার খান
গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার একটু বেশিই খেতে হয়। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে গর্ভের সন্তানের ওপরও। অর্থাৎ এমন সময় মা যদি নিজের শরীর-স্বাস্থ্য়ের প্রতি যত্নবান হয়, তবে নিজে যেমন সুস্থ থাকবে, তেমনই সুস্থ-সবল সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে শতকরা ৯৫ ভাগ।
শীতকালে বাজারে লাউ, সিম, মুলা, গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, লালশাক, পালং শাক ইত্যাদি ভালোই কিনতে পাওয়া যায়। গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিনই এই খাবারগুলো কমবেশি খাওয়া উচিত। ভাত কম খেয়ে এসব বেশি খাওয়া জরুরি। তবে আলু একটু কম খাওয়াই ভালো। কেননা এতে শর্করার মাত্রা বেশি থাকে।
গর্ভকালীন সময়ে মেয়েদের নানা ফল, যেমন কৎবেল, জলপাই, কামরাঙা, তেঁতুল ইত্যাদি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি পরিমাণেই খাওয়া দরকার। আগে বলা হতো, তেঁতুল খেলে নাকি রক্ত জল হয়ে যায়। আর এখানকার চিকিৎসকরা বলে থাকেন, তেঁতুল নির্দিষ্ট পরিমাণে খেলে রক্তের সুস্থতা রক্ষা হয়। কৎবেল, তেঁতুল, জলপাই ইত্যাদি টক ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস, লোহা, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন- ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’।
যেসব মায়ের সন্তান প্রসব করানো হয় সার্জারির মাধ্যমে তাদের ইনফেকশনের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই থাকে। টক ফল এসব সমস্যা কমায়। টকফল খেলে মুখের রুচি বৃদ্ধি পায়, যা শরীর স্বাস্থ্য়ের জন্য খুবই জরুরি একটি বিষয়। বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত।
পালংশাক, লালশাক, লাউশাকে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে, যা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা কমে। এবং হজমশক্তিও বাড়ে। আঁশ জাতীয় ফল ও শাক সব্জিকে বলা হয়ে থাকে অন্ত্র পরিষ্কারক। তবে যাদের রক্তে ইউরিক-অ্যাসিডের মাত্রা বেশি, তাদের পালংশাক ও লালশাক কম খাওয়া উচিত।
ফুলকপি খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটি যেমন সুস্বাদু তেমনই মজাদার। কিডনির সমস্যা কমায় ফুলকপি। বাঁধাকপিতে রয়েছে প্রচুর ফসফরাস। যা শীতের সময়ে ঠান্ডা থেকে বাঁচায়। টমেটো ও টমেটোজাত খাবারে আছে লাইকোপেন। এই উপাদানও শরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখে। শীতের শাক সব্জি ও ফলফুল গর্ভবতী মায়ের ত্বক, চুল ইত্যাদির জন্যও উপকারী।
২. হাইড্রেটেড থাকুন
শীতকালে যেহেতু আমাদের ঘাম কম হয় এবং তেষ্টা কম পায় তাই স্বভাবতই আমরা এই সময় জল কম খাই। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এমনিতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জল পান করা উচিত।
শীতকালেও এর ব্যতিক্রম করা যাবে না। যদি আপনি জল খাওয়ার কথা ভুলে যান তবে আজকাল মোবাইলে অনেক অ্যাপস আছে যা আপনাকে সময়মতো জল পান করার কথা মনে করিয়ে দেবে।
এছাড়াও আপনি হাতের কাছে সবসময় জল ভর্তি বোতল রাখতে পারেন যাতে যখনই বোতলটি দেখবেন তখনই আপনার জল খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, এমনিওটিক ফ্লুইড কমে যাওয়া, মাথা ব্যথা ও প্রি-টার্ম লেবারের মতো জটিলতার ঝুঁকি কমায়।
৩. ত্বকের যত্ন নিন
স্নানের সময় দীর্ঘক্ষণ ধরে স্নান করবেন না কিংবা গরম জল ব্যবহার করবেন না। কারণ এগুলো ত্বকের শুষ্কতা আরও বাড়িয়ে তোলে। চেষ্টা করুন ৪-৫ মিনিটে স্নান শেষ করার এবং উষ্ণ গরম জল ব্যবহার করুন। স্নানের পরে ত্বকে ভেজা ভাব বজায় রাখতে ময়েসচারাইজার ব্যবহার করুন। হাতে, পায়ে, মুখে এবং পুরো শরীরে ময়েসচারাইজার মাখুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ময়েসচারাইজার মেখে ঘুমাতে যেতে পারেন। মনে রাখতে হবে, ত্বক একেবারে শুকিয়ে গেলে তারপর ময়েসচারাইজার মাখলে কাজ হবে না। ত্বকে ভেজাভাব থাকতেই ময়েসচারাইজার মাখতে হবে।
শীতে স্নানের সময় সাবান কম ব্যবহার করাই ভালো। কারণ সাবান ত্বকে শুষ্কতা সৃষ্টি করে। সুতরাং স্নান কিংবা হাত-মুখ ধুতে সাবান যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করবেন। এ সময় সাধারণত গ্লিসারিন সমৃদ্ধ সাবান ব্যবহার করাই ভালো।শীতে ত্বকের শুষ্কভাব দূর করতে গ্লিসারিন কিংবা অলিভ অয়েল নিয়মিত মাখতে পারেন। গ্লিসারিন হল সবচেয়ে ভালো ময়েসচারাইজার। একভাগ গ্লিসারিনের সাথে দু-ভাগ জল মিশিয়ে ব্যবহার করুন। গ্লিসারিনের আঠা-আঠা ভাবটা দূর করার জন্য গ্লিসারিন মাখার পর একটা ভিজে তোয়ালে বা কাপড় হালকা করে ত্বকে চেপে ধরলে আঠাভাব চলে যাবে।
রোদে বের হওয়ার আগে অবশ্যই ত্বকে সানস্কিন ক্রিম মেখে বের হতে হবে। শীতের রোদ মিষ্টি আমেজ সৃষ্টি করলেও ত্বকের জন্য তা ক্ষতিকর। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ত্বকের ক্ষতি করে। ত্বকের ক্যান্সার ঘটা বিচিত্র কিছু নয়। তাই ত্বকের রক্ষা করতে হলে সানপ্রোটেকটিভ ফ্যাক্টর বা এস পি এফ সমৃদ্ধ ক্রিম মেখে বের হওয়াই ভালো। বিভিন্ন মাত্রার এস পি এফ সমৃদ্ধ ক্রিম বা লোশন রয়েছে। তবে গবেষকদের মতে এস পি এফ-১৫ সমৃদ্ধ ত্বকের জন্য নিরাপদ।
শরীরের ত্বকের শুষ্কতার সাথে পাল্লা দিয়ে ঠোঁটের শুষ্কতাও এ সময়ে মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায়। অনেকে এ সময়ে জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট ভেজাতে থাকেন, যা ঠোঁটের কোমল ত্বকের জন্য আরও ক্ষতিকর। সবচেয়ে ভালো হয় ঠোঁটে বারবার ভেসলিন মাখা। যদি ভেসলিন শুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, তা হলে গাঢ় করে ভেসলিন মাখতে হবে। ঠোঁটের উপরিভাগে পাতলা শুষ্ক ত্বক কখনও টেনে তোলার চেষ্টা করবেন না, তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।
নিয়মিত ম্য়াসাজ করাতে পারেন। এর ফলে রক্ত চলাচল ভালো থাকে যা ত্বকের জন্য উপকারী।
৪. ব্যায়াম করুন
শীতকালে আলসেমি ভর করে বলে অনেকে ব্যায়াম করতে চান না এমনকি অনেকেই শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে দেন। এটা একেবারেই উচিত নয়। সকালে বা বিকালে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন। ব্রিদিং টেকনিক ফলো করুন। এটি প্রসবের সময় কাজে দেবে। এছাড়াও মনকে শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন করতে পারেন। গর্ভাবস্থায় উপযোগী ব্যায়ামগুলো জানতে আমাদের লেখা আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
৫. আরামদায়ক গরম পোশাক পরুন
শীতের সোয়েটার কিংবা গরম কাপড় বাছাইয়ের দিকে মন দিন। এমন কিছু কিনতে বা পরতে যাবেন না, যাতে করে পেটের উপর চাপ পরে এবং চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। লম্বা এবং সামনের দিকে বোতাম আছে এমন সোয়েটারগুলো এই সময় গর্ভবতী মায়েদের আরাম দিতে পারে।শীতের কাপড়ের সঙ্গে জুতোর দিকেও নজর দিতে ভুলবেন না যেন। পা থেকে ঠান্ডা লেগে আপনার এবং আপনার সন্তানের সমস্যা হতে পারে। তাই যাতে পা ভালোভাবে ঢাকা থাকে এমন জুতো পরবেন এবং ঘরে মোজা পরে থাকতে পারেন।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান এবং সুরক্ষিত থাকুন
শীতকালে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আপনি শীত কমানোর ব্য়বস্থা হয়তো করতে পারবেন না, কিন্তু নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অনেক কিছুই করতে পারেন। নিয়মিত সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোওয়ার অভ্যাস করুন। এটা বিভিন্ন সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায়। তাজা ফল এবং শাক সব্জি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জল শরীরকে হাইড্রেটেড রাখার পাশাপাশি শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। তুলসি চা পান করুন। তুলসি কফ দূর করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত হালকা গরম জলে লবণ দিয়ে কুলি করুন। এতে গলার সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।
৭. সর্দিকাশি যদি হয়েই যায় তবে তা নিরাময়ের বাবস্থা করুন
অনেক গর্ভবতী মায়েরাই সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে সর্দিকাশিতে ওষুধ খেতে চান না। তবে যদি আপনার সর্দিকাশি দুই-তিন দিনের বেশি থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে এবং চিকিৎসা করাতে হবে। এসব সর্দিকাশি সংক্রমণ বা জীবাণুবাহিত রোগের লক্ষণ হতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছ থেকে এই সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন।
ডাক্তার এই সময় আপনাকে গর্ভকালীন অবস্থায় নিরাপদ ওষুধই দেবেন। যদি মায়ের ঠান্ডার সমস্যা আগে থেকেই থাকে তবে ঠান্ডা জল ব্যবহারে এবং ঠান্ডা কিছু খাওয়ার আগে সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়।
সান নিউজ/পিডিকে/এস