আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৪৭ বছর এক সঙ্গে থাকার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে বেরিয়ে আসল যুক্তরাজ্য। এরমধ্য দিয়ে গণভোটে রায়ের সাড়ে তিন বছর পর এক কোটি ৭৪ লাখ ব্রিটিশের ইচ্ছা পূরণ হলো, কার্যকর হলো ব্রেক্সিট।
শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১১টায় (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর ৫টা) ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বহুল আলোচিত বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটিতে যুক্তরাজ্যে যেমন উৎসব হয়েছে তেমনি এর প্রতিবাদে বিক্ষোভও হয়েছে।
প্রায় ৩ হাজার কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যয়ে চূড়ান্ত হয়েছে ইইউ প্রত্যাহার চুক্তি। গত বুধবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে ৬২১-৪৯ ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে পাস হয় চুক্তিটি। ওই চুক্তি অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে ব্রেক্সিট। বিচ্ছেদের ঐতিহাসিক এই মুহুর্তে ব্রেক্সিট পন্থী ও বিরোধীরা যুক্তরাজ্য জুড়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে।
ব্রেক্সিট কার্যকরের সময় লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে উৎসবে মেতে ওঠে এর সমর্থকরা। আর ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়া স্কটল্যান্ডের বাসিন্দারা ব্রেক্সিটের প্রতিবাদে মোমবাতি মিছিল করে। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে হয়েছে ব্রেক্সিট বিরোধী বিক্ষোভ। তিন বছরেরও বেশি সময় আগের গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দেয়া ওয়েলশের ফার্স্ট মিনিস্টার বলেছেন, ব্রেক্সিটের পরও ওয়েলশ ইউরোপীয় রাষ্ট্রই থাকবে।
জোটের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্যের বিদায়ের ক্ষণে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন দেশকে একতাবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রেক্সিট কার্যকরের কিছু সময় আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া বার্তায় তিনি বলেছেন, “অনেকের জন্য এটি একটি অবিস্মরণীয় আশার মুহুর্ত; এমন এক মুহুর্ত যা কখনো আসবে না বলেও অনেকে মনে করেছিলেন। অনেকে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। তৃতীয় গোষ্ঠীটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড়, যারা ভাবতে শুরু করেছেন যে রাজনৈতিক এ বিতণ্ডা বোধহয় আর কখনোই শেষ হবে না। আমি সব অনুভূতিই বুঝি। আমাদের সরকারের কাজ হচ্ছে, আমার কাজ হচ্ছে দেশকে একতাবদ্ধ করা এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ব্রেক্সিট ‘কোনো শেষ নয় বরং নতুন শুরু’বলেও মন্তব্য করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাজ্যজুড়ে বিভিন্ন বার ও ক্লাবে নেচে, গেয়ে ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদ উদ্যাপন করেছে ব্রেক্সিট পার্টি। পার্লামেন্ট চত্বরে জড়ো হয়ে হাজারো মানুষ গেয়েছে দেশাত্মবোধক সংগীত। এখানে বক্তব্য দেয়াদের তালিকায় ছিলেন নাইজেল ফারাজের মতো কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিরা। এর আগে ইইউপন্থিরা হোয়াইটহলে ব্রেক্সিটবিরোধী সমাবেশ করে।
ব্রেক্সিটকে স্মরণীয় করে রাখতে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক হয় সান্ডারল্যান্ডে। ২০১৬ সালের গণভোটের ফল গণনার সময় এ শহরই প্রথম ব্রেক্সিটের পক্ষে তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছিল।
বিচ্ছেদের ক্ষণ গণনার সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট হয়ে উঠেছিল আলোকজ্জ্বল। মুহুর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে ছাড়া হয় ৫০ পয়সার বিশেষ মুদ্রা। ব্রেক্সিটের পরপরই ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদরদফতর থেকে নামিয়ে ফেলা হয় যুক্তরাজ্যের পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক।
ব্রেক্সিট কী?
ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার বিষয়টিই ‘ব্রেক্সিট’ নামে পরিচিত। ব্রিটেনের ব্রি ও এক্সিট (প্রস্থান) মিলে ব্রেক্সিট শব্দটি গঠিত। অতীতে ইউরো মুদ্রা থেকে গ্রিকের বেরিয়ে আসাকেও বলা হয়েছিল গ্রেক্সিট। ২০১৬ সালের দিকে ব্রেক্সিট শব্দটি অক্সফোর্ড অভিধানে স্থান পায়।
থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ইনফ্লুয়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা পেটার উইল্ডিং ২০১২ সালের মে মাসে ব্রেক্সিট শব্দটি লিখেছেন। তার আট মাস আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করেন, ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটবে কিনা, তা নিয়ে তিনি গণভোটের আয়োজন করবেন।
কেন ইউরোপ ছাড়ছে ব্রিটেন?
অনেক ব্রিটিশ নাগরিক নিজ দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধ মেনে চলা নিয়ে বেশ নাখোশ। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে ব্রিটিশদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। ইইউর নিয়মানুযায়ী, ইউনিয়নের ২৮ দেশ ভিসা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলাচল করতে পারে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার সরকারের প্রথম মেয়াদে ইইউর বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপীয় নাগরিকদের প্রবেশ ঠেকাতে পারেননি।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, দ্বিতীয় মেয়াদে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করতে চার বছরের জন্য সুবিধা বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। এতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তারা সদস্য দেশের নাগরিকদের সুবিধা ভাতা দেয়ায় বৈষম্য হলে তা ইইউর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে দাবি তোলেন। আর এ কারণেই যুক্তরাজ্যকে ইইউতে রাখা না রাখার ব্যাপারে প্রশ্ন তৈরি হয়।
ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইইউভুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে অভিবাসীদের সুবিধা সীমিত করাসহ চারটি সংস্কার প্রস্তাব দেন ক্যামেরন এবং পরবর্তী সময় সে প্রস্তাব নিয়ে ক্যামেরনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেন ইইউ নেতারা।
দেশে ফিরে ব্রেক্সিটের বিষয়ে ২০১৬ সালের ২৩ জুন দেয়া গণভোটে ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে দেশটির জনগণই চূড়ান্ত রায় দেন।
যাতে ৫১.৯ শতাংশ লোক ব্রেক্সিটের পক্ষে ও ৪৮.১ শতাংশ বিপক্ষে ভোট দেন। তিন কোটিরও বেশি লোক এতে ভোট দেন।
ব্রেক্সিটের কারণে যেসব পরিবর্তন আসবে:
১. ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারাবেন যুক্তরাজ্যের এমপিরা:
নাইজেল ফারাজ এবং অ্যান উইড্ডেকমবের মতো পরিচিত মুখগুলোসহ যুক্তরাজ্য থেকে ৭৩ জন সদস্য ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার ফলে তারা তাদের সদস্যপদ হারাবেন।
কারণ যুক্তরাজ্য একই সাথে ইইউ'র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিগুলোও ছেড়ে যাচ্ছে। তবে যেহেতু যুক্তরাজ্য অন্তর্বর্তী সময়ে ইইউ'র আইন কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে সেহেতু ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস আইনি সমস্যাগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দেয়া অব্যাহত রাখবে।
২. ইইউ সামিটে আর নয়:
ভবিষ্যতে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সামিটে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অংশ নিতে চান তাহলে তার জন্য দরকার হবে বিশেষ আমন্ত্রণ।
ব্রিটিশ মন্ত্রীরাও এখন থেকে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মিত বৈঠকগুলোতে অংশ নিতে পারবেন না।
৩. বাণিজ্য বিষয়ে অনেক কিছু শোনা যাবে:
যুক্তরাজ্য তাদের পণ্য ও সেবা বিক্রি বা এসব কেনার জন্য নতুন নিয়ম ঠিক করতে বিশ্বের যে কোনো দেশের সাথে আলোচনা শুরু করতে পারবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকার সময়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য আলোচনা করতে পারতো না। এখন ব্রেক্সিট সমর্থকরা বলছেন নিজের বাণিজ্য নীতি ঠিক করার স্বাধীনতা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
৪. যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টের রং পরিবর্তন হবে:
নীল রংয়ের পাসপোর্ট আবার ফিরে আসবে ত্রিশ বছর পর। ২০১৭ সালে এ পরিবর্তনের কথা ঘোষণা দিয়ে তখন অভিবাসনমন্ত্রী ব্রান্ডন লুইস দেশটির ঐতিহ্যবাহী নীল ও সোনালী ডিজাইনের পাসপোর্ট আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। এ পাসপোর্ট প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিলো ১৯২১ সালে। তবে বর্তমান যে পাসপোর্ট আছে সেটিও বৈধ থাকবে।
৫. ব্রেক্সিট কয়েন:
প্রায় ত্রিশ লাখ বিশেষ কয়েন আসবে যেখানে ৩১শে জানুয়ারি এবং লেখা থাকবে 'পিস, প্রসপারিটি অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ উইথ অল নেশনস'। কিন্তু এ কয়েনকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এক পক্ষ ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে তারা এ কয়েন বর্জন করবে। তবে সরকার একই ধরণের আরেকটি কয়েন আনার পরিকল্পনা করছে যেখানে উল্লেখ থাকবে ৩১শে অক্টোবর, যে তারিখে প্রকৃতপক্ষে ব্রেক্সিট কার্যকরের কথা ছিলো।
৬. বন্ধ হবে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট ডিপার্টমেন্ট:
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাজ্যের যে বিভাগ আলোচনা চালিয়েছিলো সেই বিভাগটি বন্ধ হয়ে যাবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরেজা মে'র সময়ে ওই বিভাগটি চালু করা হয়েছিলো ২০১৬ সালে। সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাজ্যের নেগোসিয়েশন টিম হবে ডাউনিং স্ট্রীট অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ভিত্তিক।
৭. জার্মানি কাউকে যুক্তরাজ্যে প্রত্যর্পণ করবে না:
সন্দেহভাজন অপরাধী যদি কেউ যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নেয় তাহলে তাকে ফেরত পাবে না যুক্তরাজ্য। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিককে প্রত্যর্পণের সুযোগ নেই, জার্মান সংবিধান অনুযায়ী। যুক্তরাজ্যের হোম অফিস বলছে ইউরোপিয়ান অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে অন্তর্বর্তী সময় পর্যন্ত।
যেসব বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসবেনা:
১. ভ্রমণ:
অন্তর্বর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা ভ্রমণের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের লাইনেই দাড়াতে পারবেন।
২. ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পেট পাসপোর্ট:
এগুলোর বৈধতা অব্যাহত থাকবে।
৩. ইউরোপিয়ান স্বাস্থ্য বীমা স্কার্ড:
এ কার্ড দিয়েই যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
৪. ইউরোপীয় ইউনিয়নে বসবাস ও কাজ:
অন্তর্বর্তী সময়ে চলাচলের স্বাধীনতা অব্যাহত থাকবে। তাই যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা ইইউভুক্ত দেশে বসবাস ও কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। ইইউভুক্ত অন্য দেশের নাগরিকরাও একই সুবিধা পাবে যুক্তরাজ্যে।
৫. পেনশন:
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশে বসবাসরত যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা রাষ্ট্রের পেনশন সুবিধা পাবেন।
৬.বাজেটে অবদান
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেটে অন্তর্বর্তী সময়েও অবদান রেখে যাবে যুক্তরাজ্য।
৭. বাণিজ্য:
যুক্তরাজ্যের সাথে ইইউ'র বাণিজ্য অব্যাহত থাকবে নতুন কোন চার্জ আরোপ ছাড়াই।
সান নিউজ/সালি