সান নিউজ ডেস্ক:
‘৬-এর ওপরে থাকা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫-এ নেমে আসতে পারে, এমনকী তা নামতে পারে আরও নিচে।’ এই মন্তব্য দেশটির সরকারের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ঝ্যাং মিঙ-এর। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২০২০-এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ থেকে ২ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ এডওয়ারা্ড গ্লোসিপ-এর।
মরণঘাতী করোনাভাইরাসে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের বাজারের ওপর এই হুমকী পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে পড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম, নিম্নমুখী সূচক প্রধান প্রধান সব শেয়ারবাজারও।
ইকোনোমিস্ট, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো গণমাধ্যম করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে। বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য এরইমধ্যে করোনা ভাইরাসের প্রভাব টের পেতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ারের দরপতন হয়েছে প্রায় আট শতাংশ। অন্যদিকে, লন্ডনের এফটিএসই সূচকের পতন গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মঙ্গলবারও লেনদেনের শুরুতে পতনের ধারা অব্যাহত ছিল। এক্ষেত্রে চীনে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বেশি, তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত দশ দিনে ১.৩ শতাংশ কমেছে এমএসসিআই ওয়াল্ড ইন্ডেক্স, যা ২৩টি বাজারকে সূচিত করে ৷ এই সময়ে ভারতের সেনসেক্সকেও প্রায় ২ শতাংশ নামতে দেখা গিয়েছে ৷ মঙ্গলবার সেনসেক্স দশমিক ৪৬ শতাংশ নিচে নামে। দু’দিন আগে জার্মানির ডিএএক্স ও ফ্রান্সের সিএসি ৪০ উভয় সূচকই পড়ে গেছে ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি।
ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সাংহাই ও হংকংয়ের পার্ক বন্ধ করে দিয়েছে ডিজনি। তাদের দরপতন হয়েছে তিন শতাংশেরও বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভ্রমণ কোম্পানিগুলোও।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সোমবার ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমে তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে ঠেকেছে। এদিন ব্রেন্ট ব্র্যান্ডের তেল ব্যারেলপ্রতি ৫৯ ডলার ৩২ সেন্টে বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের ২১ অক্টোবরের পর সর্বনিম্ন।
পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বারবেরির ১৬ শতাংশ পণ্য বিক্রি হয় চীনে। সোমবার লন্ডনে তাদের শেয়ারের দাম কমে গেছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
চীনের ম্যাকাও শহরে ক্যাসিনো ব্যবসা আছে উইন রিসোর্টসের। দরপতনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। দেশটিতে বহুল জনপ্রিয় এলভিএমএইচ, কেরিং, ল’রিয়্যাল ও হার্মেসের মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর শেয়ারের দাম গত মাসে রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ধাক্কা এসেছে তাদের ওপরও।
চীনের অর্থনীতির ১১ শতাংশ নির্ভর করে পর্যটন খাতের ওপর। এ খাতকে ঘিরে কাজ করে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। ২০১৮ সালে দেশটিতে পর্যটক এসেছে ৬ কোটি। প্রচন্ডভাবে হুমকীর মুখে খাতটি। ভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় চীন ভ্রমণে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফ্লাইট, হোটেল বুকিং বাতিল হওয়ায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটির পর্যটন খাত। সেখানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ, যান চলাচল বন্ধ, বিমান বন্ধ, ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। হুবেই প্রদেশের অন্তত ১৬টি শহরে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। লুনার ইয়ার উপলক্ষে প্রতিবছরই এ সময়ে চীন পর্যটনমুখর থাকলেও সেখানে থমথমে অবস্থা। এই সময়টিতে কয়েক লাখ মানুষ দেশটিতে ভ্রমণে যাওয়ার কথা থাকলেও ভাইরাস আতঙ্কে ফ্লাইট বাতিল করছেন অনেকে, বাতিল করছেন হোটেল বুকিংও। যাত্রীদের আগের বুকিং দেয়া ফ্লাইটের ভাড়া ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীনা সাউদার্ন এয়ারলাইন্স, চীনা ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স ও চীনা এয়ার।
সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে চীনের ওষুধ খাতের জন্য। করোনা ভাইরাস আতঙ্কের কারণে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জ্বর-ঠান্ডাজনিত রোগের ওষুধ কিনতে। বিশ্বে অন্যতম বড় সংকট হয়ে যেটি আসতে পারে তা হচ্ছে, ওষুধ সরবরাহে ঘাটতি।
সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী উইয়ার্ড প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের উৎস চীনে, আবার এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর বড় উৎপাদকও তারা। মানুষ জীবনরক্ষাকারী পণ্যের জন্য চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশ্বে ওষুধের উপাদান উৎপাদনকারী অন্যতম দেশও চীন।
প্রাণঘাতী ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ানোর কারণে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনে একটি বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা থেকে কুনমিং এবং গুয়াংজুগামী ফ্লাইটে যাত্রী সংখ্যা গত কয়েক দিনে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। বাতিল হচ্ছে পূর্ব নির্ধারিত ফ্লাইট। ফ্লাইটের বুকিং বাতিল করা ছাড়াও টিকেট কনফার্ম থাকার পরও যাত্রী বিমানবন্দরে উপস্থিত না হওয়ার (নো শো) পরিমাণ বড়ছে। চীনের প্রচুর ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষও অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণ ছাড়াও ভ্রমণে চীনকে বেছে নেন। বিশেষ করে শীতকাল বা তার কাছাকাছি সময়ে। সেসববে এক ধরণের স্থবিরতা নেমে আশঙকা বিশ্লেষকদের। এছাড়া এরইমধ্যে দেশের আমদানী এবং রপ্তানীখাতে বড় ধাক্কা লেগেছে এই করোনা ভাইরাসের কারণে।
অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে, এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের অর্থনীতি রীতিমতো ঝুঁকির মুখে পড়বে যদি আগামী কয়েক সপ্তাহে করোনা ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ে৷ বিশ্ব অর্থনীতিতে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেটা নির্ভর করছে চিনের উহান শহরে এই মহামারী কত তাড়াতাড়ি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার উপর৷ সব মিলিয়ে নতুন এক সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি।
এর আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার। লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জেনিফার ম্যাককেওন জানান, ২০০৩ সালে সার্সের কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল পুরো এক শতাংশ। অর্থনীতিতে এটা অনেক বড় ধাক্কা হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, সে সময় যেসব বিষয় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছিল তাদের চিত্রটি বেশ জটিল। তার মতে, সার্স অনেক ভয়ংকর এবং বিস্তৃত ভাইরাস হলেও বৈশ্বিক জিডিপিতে (অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ) এর স্থায়ী ক্ষতি বাছাই করা বেশ কঠিন'। সার্সের সঙ্গে তুলনা করে করোনাভাইরাসের ক্ষতিটি আরও ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা অর্থনীতি বিশ্লেষকদের।
উল্লেখ্য, মরণঘাতি করোনাভাইরাসে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত চীনে মৃত্যের সংখ্যা ১৭০-এ পৌঁছেছে, আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৭ শো ১১ জন।
চীন ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, আরব আমিরাত, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডাসহ অন্তত ১৬টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে।