আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনের মধ্যস্থতায় সাত বছর ধরে চলা বৈরিতা ভুলে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব এবং ইরান আবারও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৬ সালে এক শিয়া ধর্মগুরুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং এর জেরে তেহরানে সৌদির দূতাবাসে হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশ সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে ধস
কিন্তু গতকাল শুক্রবার (১০ মার্চ) চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে ঘোষণা আসে আবারও এক হচ্ছে এ দুই দেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের মাধ্যমে সৌদি আরব ও ইরানের এক হওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘বিশ্ব শাসন ব্যবস্থায়’ পরিবর্তন আসছে।
শুক্রবারের আলোচনা শেষে ইরান ও সৌদি আরব ঘোষণা দেয় তারা একে-অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না এবং অখণ্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকবে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমান জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ওয়াং উইয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলী সামখানি এবং সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক মুয়াদ বিন মোহাম্মদ আল-আইবান।
সৌদি ও ইরানের মধ্যকার বিরাজমান দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব নিরসনে যে চীন কাজ করছে এ বিষয়টি আগে কখনো জানানো হয়নি।
আরও পড়ুন: উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় বিশ্বের প্রথম থ্রিডি রকেট
চীনের মধ্যস্থতাকারী ওয়াং উই এ ঘোষণার পর জানিয়েছেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতকারী’ দেশ হিসেবে চীন তার দায়িত্ব পালন করেছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
২০১৬ সালে শিয়া ধর্মগুরুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে ইরান-সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল অনেক আগে থেকেই।
মধ্যপ্রাচ্যে যেসব যুদ্ধ বা সংঘাত হয়েছে সেগুলোর সবগুলোতেই পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সৌদি আরব এবং ইরান। দুই দেশের কেউই কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেনি।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজে অজানা রোগ
দীর্ঘ ৮ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলা ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের সহায়তা করে যাচ্ছে ইরান। অপরদিকে সরকারি বাহিনীকে সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব। এছাড়া আরও যেসব আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে সেখানেও এ দুই দেশ বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তারা আবার এক হওয়ায় আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং দ্বন্দ্বগুলোর তীব্রতা কমে যাবে বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক আরব গালফ স্টেট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ স্কলার রবার্ট মোগেলিঙ্কি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে চীনের ভূমিক প্রমাণ করছে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করছে বেইজিং।’
‘সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্য ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা মানে হলো— আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব কমে আসবে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা হ্রাস পাবে। এ বিষয়টি চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক সব শক্তির জন্য ভালো।’
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাখামাখি নয়
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ গবেষক সিনা তোসোই আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘চীন পরিষ্কারভাবে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতায় আগ্রহী। কারণ আরব সাগরীয় দেশগুলো চীনের জ্বালানির অন্যতম বড় সূত্র। চীন সৌদি এবং ইরান দুই দেশ থেকেই জ্বালানি আমদানি করে।’
সিনা তোসোই বলেছেন, ‘এ বিষয়টি চীনের জন্য চরম বিপর্যয়কর ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো সংঘাত চীনের জ্বালানি সরবরাহে প্রভাব ফেলবে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি করবে।’
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পার্সি বলেছেন, চীন মধ্যপ্রাচ্যে কোনো দেশের পক্ষে অবস্থান নেয়নি এবং এ অঞ্চলে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে। ফলে তারা সহজেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে।
আরও পড়ুন: ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে সৌদির শর্ত!
এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, ‘চীনের এ মধ্যস্থতা নির্দেশ করছে বিশ্ব শাসনে পরিবর্তন আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা গিয়েছিল সেটি শেষ হয়ে আসছে।’
তিনি আরও জানিয়েছেন, ইরানকে বেকায়দায় রাখতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে কোনো শর্ত ছাড়াই সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু হয়তবা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বুঝতে পেরেছেন, সৌদি আরবের পাশে ইরান থেকে যাবে। কিন্তু যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহায়তা বন্ধ করে দেয় তাহলে তারাই বিপদে পড়বে। এ কারণে ইরানের সঙ্গে থাকা দূরত্ব নিরসন করতে চাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন: চীনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং
শিয়াপন্থী মুসলিম অধ্যুষিত ইরানের সঙ্গে সুন্নিপন্থী সৌদি আরবের সম্পর্ক কখনো তেমন উষ্ণ ছিল না। তবে ২০১৬ সালে দুই দেশের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটে। ২০১৬ সালে ইরানে বিক্ষোভকারীরা সৌদি দূতাবাসে হাঙ্গামা করার পর তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ। সৌদি আরব একজন শিয়া ধর্মগুরুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ইরানে ওই বিক্ষোভ হয়েছিল। এছাড়া দুদেশের দ্বন্দ্ব পারস্য উপসাগর এলাকায় যে কেবল উত্তেজনা বাড়িয়েছে তাই নয় বরং ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সংঘাতকে আরও গভীর করেছে।
সান নিউজ/এসআই