সান নিউজ ডেস্ক : দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আম আদমি পার্টির (আপ) মুঠো আরও শক্ত করে ফেললেন। অবশেষে রাজধানীতে বিজেপির টানা দেড় দশকের পৌর-শাসনকালের সমাপ্তি ঘটল।
আরও পড়ুন : ৩ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা
বুধবার (৭ ডিসেম্বর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এমনটিই খবর দিচ্ছে।
সূত্রমতে, ওয়ার্ড সংখ্যার বিচারে গত বারের ভোটে আম আদমি পার্টির প্রাপ্তি ছিল ৪৮ (২৭০ আসনে ভোট হয়েছিল)। এ বার ২৫০ আসনের মধ্যে আপ জিতেছে ১৩৪টি আসন।
২০১৭-এর তুলনায় ৮৬টি বেশি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে, আপ এ বছর পেয়েছে ৪২.২ শতাংশ ভোট। ২০১৭ সালের পৌর-ভোটে আপ ভোট পেয়েছিল ২৬.২৩ শতাংশ।
আরও পড়ুন : খাবারে বিষক্রিয়া, অসুস্থ ১২০০ শিক্ষার্থী
শতাংশের বিচারে ভোট বেড়েছে বিজেপিরও। তারা পেয়েছে ৩৯.১২ শতাংশ ভোট, যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৬.০৮ শতাংশ। ২০১৭-এর তুলনায় ভোট বাড়লেও, বিজেপির জেতা ওয়ার্ড ১৮২ থেকে নেমে এল ১০৪-এ। কংগ্রেস পেয়েছে ১১.৬৪ শতাংশ ভোট। গত ভোটে পেয়েছিল ২১.০৯ শতাংশ। কংগ্রেসের ওয়ার্ড ছিল ৩০। এ বার তা নেমে এসেছে ৯-এ।
দিল্লির ভোটে আপের এই লাফ চমকপ্রদ। কারণ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে আপকে খালি হাতে ফিরিয়েছিলেন দিল্লির বাসিন্দারা।
কিন্তু ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটে তারাই দুর্দান্ত জয় এনে দিয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। পৌরসভায় ১৫ বছরের বিজেপি শাসনকে দূরে ঠেলে, এবার তারা কেজরীওয়ালের বাহিনীর পাশে দাঁড়াল। ভোট এবং আসন— উভয় ক্ষেত্রেই এবার বিশাল লাফ দিল আপ।
আরও পড়ুন : পেরুর ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট
আপের এই জয়ের পর উঠে আসছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন জাদুতে পৌরসভার দখল সম্পন্ন করল আপ? কী কৌশলে বিজেপির মতো সংগঠিত দলকে পৌর-ক্ষমতা-ছাড়া করলেন কেজরিওয়াল?
সর্বোপরি, বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ স্লোগানকে তাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কতটা ফয়দা তুলতে পারলেন খড়্গপুর আইআইটির সাবেক?
ঘটনা হল, গত ২৪ বছর ধরে বিজেপির দিল্লি বিধানসভায় জয় অধরা রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপ বা কংগ্রেস, রাজ্য সরকার যার হাতেই থাক না কেন, দিল্লি পৌরতে বিজেপির দাপট গত দেড় দশক অটুট ছিল।
আরও পড়ুন : পেরুতে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট গ্রেফতার
এমনকি, ২০১৫-এর বিধানসভা ভোটে দিল্লিবাসী আপকে ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন দিলেও, দু’বছর পর হওয়া ভোটে বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু কোন জাদুতে এ বার এমন জয় পেলেন কেজরিওয়াল, সিসৌদিয়ারা?
প্রসঙ্গত, ১৯৫৮ সালে তৈরি হয় দিল্লির পৌরসভা (পুরনিগম)। ২০১২ সালে তাকে তিন খণ্ডে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। তৈরি হয় এনডিএমসি (উত্তর দিল্লি পুরনিগম), এসডিএমসি (দক্ষিণ দিল্লি পুরনিগম) এবং ইডিএমসি (পূর্ব দিল্লি পুরনিগম)।
২০২২-এর ২২ মে তিনটি পৌরসভাকেই ভেঙে দিয়ে গড়া হয় দিল্লি পৌরসভা বা ‘মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি’ (এমডিসি)।
আরও পড়ুন : বর্ষসেরা ব্যক্তি’ জেলেনস্কি
সেই সময় রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওঠাপড়ার সাথে জড়িতদের কেউ কেউ বলেছিলেন, পৌর পুনর্দখলের উদ্দেশেই মোদী এ কাজ করলেন। কিন্তু ভোটের ফল বলছে ভিন্ন কথা। সম্ভবত, বিজেপির কৌশলীরা যে কথা হিসাবের মধ্যেই আনেননি।
প্রথমত, গত লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকেই আপ নতুন করে কৌশল সাজিয়েছিল। বিধানসভা ধরে রাখার পাশাপাশি লক্ষ্য ছিল পৌর দখলও। কেজরিওয়ালদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, রাজধানীর জনগণ কেবলমাত্র পরিষেবার জন্যই বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন, ব্যাপারটা এতটা সরল নয়।
আসলে বিজেপির রাজনৈতিক লাইনের সাথেও একাত্মবোধ করেন বহু মানুষ। তাই বিজেপি বা মোদীকে আক্রমণ করতে গিয়ে বিজেপির আদি ও অকৃত্রিম রাজনৈতিক গতিপথকে বিঁধতে গেলে ফল অন্য রকম হতে পারে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণে গেলেও বিজেপির সামগ্রিক হিন্দুত্বের নীতির সমালোচনা শোনা যায়নি কোনো আপ নেতার গলায়।
আরও পড়ুন : দোষী সাব্যস্ত ট্রাম্পের কোম্পানি
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় দিল্লিতে হিংসা হয়েছিল যে এলাকায়, সেখানে প্রার্থী দেয়নি আপ। সমর্থন করেছিল নির্দলীয় প্রার্থীকে। অর্থাৎ, দিল্লির মতো জায়গায় আপকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে প্রচার করার সুযোগ পায়নি বিজেপি। তার ‘ডিভিডেন্ড’ ঢুকেছে ঝাড়ুর তহবিলেই।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের প্রচার করে গোটা দেশে। অর্থাৎ, কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেও বিজেপির সরকার। দিল্লি পৌরতে বিজেপির সেই স্লোগানই নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে পাল্টা দিয়েছেন কেজরিওয়াল। আপের প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল, রাজ্যের পাশাপাশি পৌরসভাতেও থাকুক আপ। তাহলেই দিল্লির সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের সহায় হয়েছে দিল্লি সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাফল্যের প্রচার। ফলে অচিরেই গতি পেয়েছে আপের ‘ডবল ইঞ্জিন’ স্লোগান। যার পাল্টা কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি।
আরও পড়ুন : ইউক্রেনে রুশ হামলায় নিহত ৪
তৃতীয়ত, জঞ্জাল সাফাই এ বারের দিল্লি পৌরসভার ভোটে অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। বিজেপি ও আপ, একে অপরকে বার বার এই জঞ্জাল প্রসঙ্গেই বিঁধেছে। রাজ্য সরকার যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বুনিয়াদি বিষয়ে অসামান্য কাজের দাবি করে ঢালাও প্রচার করছে, সেখানে জঞ্জাল নিয়ে বিড়ম্বনা কেবল বেড়েইছে বিজেপির।
এই পরিস্থিতিতে আপের প্রচার ছিল, ঠিক যেভাবে দিল্লির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আমূল উন্নতি করেছেন কেজরিওয়াল, পৌরসভার ভার পেলে জঞ্জাল সাফাই নিয়েও তেমনই গর্ব করতে পারবেন দিল্লিবাসী। এ জন্য পরিকল্পনা কী হবে, জনসভায় দাঁড়িয়ে আপ নেতারা তারও বর্ণনা দেন।
আরও পড়ুন : আফগানিস্তানে বিস্ফোরণে নিহত ৭
দিল্লির পৌরসভা দখলে যাচ্ছে আপের, বেশির ভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষায় তেমনই ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু মেলেনি যেটা, সেটা হলো, আপ-ঝড়ের সামনে বিধানসভার মতোই খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে বিজেপি।
ফল বলছে, মোটেই তেমন কিছু হয়নি। আপ পুরনিগম দখল করেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপি ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবে সওয়ার হয়েও এক শ’র বেশি আসনে জিততে পেরেছে। তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে রাজধানীর ভোট ময়দানে। সূত্র : আনন্দবাজার।
সান নিউজ/এইচএন