আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মার্কিন মিডিয়ার সংবাদ অনুযায়ী চলতি বছরের আগস্টে তাইওয়ান সফর করবেন দেশটির তৃতীয় ক্ষমতাধর রাজনীতিক, কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।
আরও পড়ুন : অকটেন-পেট্রোল আমাদের কিনতে হয় না
তবে কোন দিন ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে যাবেন তা প্রকাশ করা হয়নি, তবে এই সংবাদ জানার সাথে সাথে চীনে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে তার নজির নেই বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি।
মার্কিনদের চীনা সরকারি কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন যে, এই সফর চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সামিল এবং এতে প্রমাণ হবে যে আমেরিকা তাদের 'এক-চীন' নীতি বর্জন করছে।
সোমবার (২৫ জুলাই) সাংবাদিকদের প্রশ্নে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, 'সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায়' শক্ত ব্যবস্থা নেবে চীন। তিনি বলেন, 'যেকোনো পরিণতির দায় নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।'
চীনে বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক যে ব্যাপারে সাধারণত কথা বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু মার্কিন স্পিকারের প্রস্তাবিত সফর নিয়ে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার মতো কড়া হুমকি শোনা গেছে সেদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে থেকে।
মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ট্যান কেফেই চায়না ডেইলি সংবাদপত্রকে বলেন, ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান গেলে চীনা পিপলস্ লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) চুপ করে বসে থাকবে না, এবং তারা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য 'পুরোপুরি প্রস্তুত।'
আরও পড়ুন : আবার ঋণ দিতে পারবো
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কর্মকর্তারা বা রাজনীতিকরা একবারেই তাইওয়ানে যান না তা নয়। কিছু দিন আগেও সাবেক ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তাইপে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ন্যান্সি পেলোসি আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীকিকদের একজন। প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই তার অবস্থান। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন নেতা তিনি।
মার্কিন রাজনৈতিক মহলে সবসময়ই তাকে কট্টর চীনবিরোধী হিসাবে দেখা হয় । চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি আগাগোড়া সোচ্চার। চীনে সফরে গিয়ে তিয়েনানমেন স্কয়ারে গিয়েছিলেন তিনি। নির্বাসিত চীনা ভিন্নমতালম্বীদের সাথে তার যোগাযোগের কথা সবাই জানে।
ফলে এমন একজন ব্যক্তির তাইওয়ানে যাওয়ার এই পরিকল্পনাকে আমেরিকান সরকারের পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি উসকানি হিসাবে দেখছে চীন।
আরও পড়ুন : জনশুমারিতে খরচ ১৫৭৫ কোটি টাকা
বিশেষ করে, অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বর্তমান যে প্রেক্ষাপট- তাতে এই সময়ে ন্যান্সি পেলোসির এই সফর চীনের ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
আর কয় সপ্তাহ বাদেই হবে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস - যেখানে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতার জন্য অনুমোদন চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
'ঠিক এই সময়ে স্পিকার পেলোসির এই সফরকে শি এবং পার্টি নেতৃত্ব অপমান হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন,' নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা সুজান এল শার্ক- যিনি চীনা রাজনীতি নিয়ে একটি বইও লিখেছেন।
'এই অপমান বোধ থেকে চিন্তা-ভাবনা না করে শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি,' বলেন সুজান শার্ক। এই বিশ্লেষক মনে করেন, 'সংঘাতের ঝুঁকি না নিয়ে এখন এই সফর স্থগিত করাই সঠিক হবে।'
আরও পড়ুন : প্রদীপের ২০, স্ত্রীর ২১ বছরের কারাদণ্ড
তাইওয়ানকে চীন সবসময় অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে, এবং তাইওয়ানের ব্যাপারে কোনো ধরণের শিথিল অবস্থান নেওয়া ক্ষমতাসীন কোনো চীনা রাজনীতিকের পক্ষে সম্ভব নয়। তা নিলে, নিশ্চিতভাবে পার্টির কোপানলে পড়তে হবে তাকে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর তাইওয়ান সরকারের সাথে তার প্রশাসনের কূটনৈতিক সম্পর্ক যেভাবে বাড়ছে তাতে চীন উদ্বিগ্ন। মাত্র গত এপ্রিলেই আমেরিকান পার্লামেন্টের ছয়জন সদস্য হঠাৎ তাইওয়ান সফরে যান। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে গত এক বছরে অন্তত তিনবার বলেছেন, তাইওয়ান আক্রান্ত হলে আমেরিকা সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করবে না।
চীন এ নিয়ে একই সাথে ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যে কয় দফায় দুই সরকারের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে - সেখানে চীনারা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
তা সত্বেও ন্যান্সি পেলোসির এই সফরের পরিকল্পনাকে আগুনে ঘি ঢালার মতো একটি কাজ হিসাবে দেখছে চীন।
আরও পড়ুন : হঠাৎ ‘অসুস্থ’ রুশ প্রেসিডেন্ট!
এদিকে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, চীনা সামরিক বিমান মার্কিন স্পিকার পেলোসিকে বহন করা বিমানকে এসকর্ট করে অর্থাৎ ঘিরে তাইওয়ানের আকাশ সীমায় চলে যেতে পারে- যাতে তিনি তাইপেতে অবতরণ করতে না পারেন।
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসাবে পরিচিতি সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসের সাবেক প্রধান সম্পাদত হু শি জিন এমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, 'চীনা যুদ্ধবিমান পেলোসির বিমানকে ঘিরে প্রথমবারের মত তাইওয়ান-নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারে। । চীনকে এবার অবশ্যই শক্ত সামরিক ব্যবস্থার পথ নিতেই হবে।'
অপরদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখছে মার্কিন কর্মকর্তারা এমন একটি সম্ভাব্য চিত্রপট নিয়ে উদ্বিগ্ন।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেক্স আজার যখন তাইওয়ান সফরে যান, চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালির মাঝ বারাবর তাইওয়ানের আকাশসীমার একদম প্রান্তে চলে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন : ইউক্রেনে ৪০ হাজার রুশ সেনা নিহত
ইচ্ছাকৃতভাবে তাইওয়ানের বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আওতার মধ্যে চীনা বিমানের চলে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল সেসময়।
বাইডেন প্রশাসন এমনিতেই তাইওয়ান নিয়ে চীনের বক্তব্য-বিবৃতি, গতিবিধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমেরিকান রাজনীতিক এবং সামরিক প্রশাসকদের একাংশের মধ্যে একটি চিন্তা ঢুকেছে যে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে চীনা নেতারা হয়তো মনে করছেন, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আমেরিকা আরও জোরদার করার আগেই ঐ দ্বীপকে জোর করে অঙ্গীভূত করে নিতে হবে।
এমন উদ্বেগের কথাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে যে চীনারা হয়ত যে কোনো সময় তাইওয়ান প্রণালীর পুরোটা অংশে অথবা অংশবিশেষে বাকিদের চলাচল বন্ধ করে দেবে।
চলতি বছরের জুন মাসে চীন বলেছে, তাইওয়ান প্রণালীতে একমাত্র তাদেরই সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
সান নিউজ/এইচএন