ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ার পর ছয় মাস পূর্ণ হবে ৩০ জুন। এর তিন দিন আগেই শনিবার (২৭ জুন) বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেল।
ক্রমাগত ভাবেই সংক্রমণের গতি বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন আরও বেশি মানুষ। শুধু আক্রান্তের সংখ্যা নয়, বাড়ছে মৃত্যুও। গতকাল রাত পর্যন্ত মৃত্যুরসংখ্যাও ছিল পাঁচ লাখ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু এই ছয় মাসেও করোনার চিকিৎসায় সার্বিকভাবে উপযোগী কোনো ওষুধ পাওয়া গেল না।
সংক্রমণ প্রতিরোধের টিকার জন্য দেশে দেশে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কিন্তু তারা কবে নাগাদ তা মানুষের হাতে তুলে দিতে পারবেন, তা–ও অনিশ্চিত।
চীনের উহানে অজ্ঞাত কারণে মানুষের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গত ৩১ ডিসেম্বর শনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর কিছুদিন পরই চীনের বিজ্ঞানীরা জানান, নতুন এই ভাইরাস সার্স-করোনাভাইরাসের গোত্রের। দ্রুতই ভাইরাসটি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গত ৩০ জানুয়ারি করোনার সংক্রমণকে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এরপর সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এই সংস্থা করোনার সংক্রমণে সৃষ্ট রোগকে ‘কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯)’ নাম দেয়।
করোনা মহামারির সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো। এই ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে বিশ্বজুড়ে করোনা রোগীর সংখ্যা কোটি ছাড়ায়। এর আগে গত শুক্রবার এক দিনে বিশ্বজুড়ে ১ লাখ ৯৪ হাজার রোগী শনাক্ত হন। করোনা মহামারি ছড়ানোর পর এদিনই সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী শনাক্ত হলেন বিশ্বজুড়ে।
প্রায় ছয় মাসে মৃত্যুও ৫ লাখ ছুঁই ছুঁই। সুস্থ হয়ে উঠেছেন অর্ধেকের বেশি রোগী।
ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফোর তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃত্যু পাঁচ ছুঁই ছুঁই ছিল। অবশ্য সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যাও কম নয়। ৫৪ লাখের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন থাইল্যান্ডে, গত ১৩ জানুয়ারি। এরপর গত ৬ মার্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়। অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা ৬৭ দিনে এক লাখ হয়। তবে এরপর যেন লাগামছাড়া হয়ে যায় সংক্রমণ। গত ২ এপ্রিল শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়ায়। মাত্র ২৭ দিনে রোগীর সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে যায়। এর ১৩ দিনের মাথায়, ১৫ এপ্রিল রোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়ায়। রোগীর সংখ্যা ৩০ লাখ হয় ২৭ এপ্রিল। এর ১২ দিনের মাথায় রোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়ায়। রোগীর সংখ্যা ৫০ লাখ হয় ২০ মে। ২৯ মে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়ায়। এর ৯ দিনের মাথায়, ৭ জুন রোগীর সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়ায় ১৪ জুন। ২১ জুন রোগীর সংখ্যা ৯০ লাখ পার হয়। আর গতকাল শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়ায়।
দেশে দেশে আক্রান্ত-
সারা বিশ্বে মোট আক্রান্তের এক–চতুর্থাংশ শুধু যুক্তরাষ্ট্রে। গতকাল রাত পর্যন্ত দেশটিতে মোট রোগী ছিল ২৫ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি। চার ভাগের আরেক ভাগ তিন দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া ও ভারতে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ব্রাজিলে রোগীর সংখ্যা ১৩ লাখ ছুঁই ছুঁই ছিল। রাশিয়ায় ৬ লাখ ২৭ হাজারের বেশি এবং ভারতে প্রায় ৫ লাখ ১৬ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বিশ্বের বাকি অর্ধেক রোগী ২১১টি দেশ ও অঞ্চলে। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা ১০টি দেশ হলো যুক্তরাজ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার, স্পেনে ২ লাখ ৯৫ হাজার, পেরুতে ২ লাখ ৭২ হাজার, চিলিতে ২ লাখ ৬৩ হাজার, ইতালিতে ২ লাখ ৩৯ হাজার, ইরানে ২ লাখ ২০ হাজার, মেক্সিকোয় ২ লাখ ৮ হাজার, পাকিস্তানে ১ লাখ ৯৮ হাজার এবং তুরস্ক ও জার্মানিতে ১ লাখ ৯৪ হাজার করে। ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭৮ জন শনাক্ত রোগী নিয়ে ১৭তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
মৃত্যু প্রায় ৫ লাখ-
গত ১১ জানুয়ারি করোনায় প্রথম মৃত্যু দেখে বিশ্ব। চীনের উহানে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির বয়স ছিল ৬১ বছর। গত ২ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে ৪৪ বছর বয়সী এক চীনা নাগরিক করোনা সংক্রমিত হয়ে মারা যান। চীনের বাইরে করোনায় এটাই প্রথম মৃত্যু। এরপর গত ৯ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃত্যু এক লাখ ছাড়ায়। অর্থাৎ প্রথম মৃত্যুর ঠিক তিন মাসের মাথায় মৃত্যু এক লাখ ছাড়ায়। মৃত্যু ২ লাখ ছাড়ায় ২৪ এপ্রিল। অর্থাৎ এবার এক লাখ মানুষ মারা যান মাত্র ১৫ দিনে। করোনা সংক্রমিত হয়ে মোট মৃত্যু ৩ লাখ ছাড়ায় গত ১৪ মে। তারপর মোট মৃত্যু ৪ লাখ ছাড়ায় ৫ জুন। আর গতকাল ২৭ জুন মৃত্যু ৫ লাখ ছাড়াল।
মৃত্যুতেও বিশ্বের শীর্ষ দেশ যুক্তরাষ্ট্র (১ লাখ ২৭ হাজারের বেশি)। ৫৬ হাজারের বেশি মৃত্যু নিয়ে ব্রাজিল দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ। করোনায় মৃত্যুতে শীর্ষ পাঁচ দেশের বাকি তিনটি হলো যুক্তরাজ্য (৪৩ হাজার), ইতালি (৩৪ হাজার) ও ফ্রান্স (২৯ হাজার)।
হেলাফেলা করে ভুগছে অনেক দেশ-
সংক্রমণ ও মৃত্যুতে শীর্ষ দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলই প্রথম দিকে মহামারিকে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন করোনা মোকাবিলার চেয়ে বাগ্যুদ্ধে মেতে সময় নষ্ট করেছে বেশি। প্রথমে চীনের সঙ্গে করোনা মহামারির উৎপত্তি নিয়ে এবং তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের সঙ্গে মহামারি মোকাবিলা নিয়ে তর্কে মেতেছেন ট্রাম্প। তবে মহামারি মোকাবিলায় যে বিষয়গুলো জরুরি, তার বেশির ভাগই তার প্রশাসন অনুসরণে আগ্রহ দেখায়নি। এর মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। মাস্ক পরা নিয়েও ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ কম।
প্রায় একই পরিস্থিতি ব্রাজিলেও। দেশটির প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোও ট্রাম্পের মতো সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মানার বিপক্ষে। এমনকি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দেওয়ার পর ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন বলসোনারো। গত এপ্রিলের ওই ঘটনার পর বিগত দুই মাসেও দেশটিতে স্থায়ী কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অঙ্গরাজ্যগুলোর কর্তৃপক্ষের জারি করা লকডাউনের বিপক্ষে বিক্ষোভেও যোগ দিয়েছেন বলসোনারো।
শুরুতে সতর্ক হয়ে সামলে চলেছে যেসব দেশ-
এ তালিকায় ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাম থাকবে সবার আগে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানও রয়েছে। এই দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত, পরীক্ষা, আইসোলেশনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে কোনো কোনো দেশ বিধিনিষেধও আরোপ করেছে। তার সুফল পাচ্ছে এই দেশগুলো। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের সরকার দেশটিকে করোনামুক্ত ঘোষণা করেছে।
চিকিৎসা: ওষুধ ও টিকা আবিষ্কারের জোর চেষ্টা-
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে দেশে দেশে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা গবেষকেরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত যে ওষুধ সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে, তা হলো রেমডিসিভির। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গিলিয়াড সায়েন্সেসের তৈরি এই ওষুধ এরই মধ্যে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। তবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে শুধু সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে, এতে মৃত্যুহার কমে।
আরেকটি ওষুধও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। সেটি হলো স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ওষুধ শুধু হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বলেছে।
এদিকে সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসেবে এখন পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওষুধ উৎপাদনকারী অ্যাস্ট্রাজেনেকার পরীক্ষামূলক টিকাটি। প্রথম টিকা হিসেবে এটি পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে।
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান অ্যান্ড্রু পোলার্ড গত বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাগুলো খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে। আমরা এখন পরীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখছি যে টিকাটি বয়স্ক ব্যক্তিদের বেলায় কতটা কার্যকরভাবে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এটি ব্যাপক জনসংখ্যার মাঝে সুরক্ষা দিতে পারবে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখছি।’
দ্রুত টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে অবশ্য শুধু অক্সফোর্ড নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও চেষ্টা করে যাচ্ছে। খোদ চীনেই বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষাধীন রয়েছে ছয়টি সম্ভাব্য টিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২২ জুন পর্যন্ত ১৩টি টিকা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে এবং ১২৯টি টিকা প্রি-ক্লিনিক্যাল বিবর্তন পর্যায়ে রয়েছে।
সান নিউজ/ আরএইচ