ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কঃ
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এখন এই মহামারির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার সমালোচক সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করছে বলে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিপাইনে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ৫ মে সন্ধ্যা সাতটা ৫২ মিনিটে দেশটির সবচেয়ে বড় সম্প্রচার-মাধ্যম এবিএস-সিবিএন-এর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। দৃশ্যত প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে সাময়িকভাবে কোম্পানিটির লাইসেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দুয়ার্তের প্রশাসন। আর দুয়ার্তের ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস কোম্পানিটির ২৫ বছর মেয়াদের লাইসেন্স নবায়নে মাসের পর মাস টেনে নিয়েছে। সাংবাদিক ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে পরিষ্কারভাবে এই বার্তা পৌঁছে গেছে যে, সরকারের কঠোর সমালোচনার পরিণাম কী হতে পারে।
ফিলিপাইনের এই ঘটনা এশিয়ার সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্মিত করবে না। পুরো মহাদেশেই সরকারি বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার, ওয়ারেন্ট ছাড়াই ট্যাক্স তদন্ত, ভুয়া অপরাধের অভিযোগ, ফেক নিউজ প্রচারণা, অনলাইন ট্রলসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের চাপ রয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মতে, ২০১৮ সাল থেকে এশিয়ার ১২টিরও বেশি দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন। সংস্থাটি ১৮০টি দেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করে তার মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়ক দেশগুলোর এক তৃতীয়াংশ এশিয়ার। তালিকার তলানিতে উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান (১৭৯তম), চীন (১৭৭তম) ও ভিয়েতনাম (১৭৫তম)।
কম্বোডিয়ায় সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রেডিও চ্যানেল এবং একটি সমালোচনামূলক পত্রিকা কম্বোডিয়া ডেইলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ গত চার বছরে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী তাদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ৫২টি মামলা দায়ের করেছে। এর অর্ধেকের বেশি দায়ের হয়েছে কেবল গত এক বছরেই। সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক হত্যার তথ্য উন্মোচন করে এক বছরের বেশি কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক। অন্যদিকে দায়ী সেনা সদস্যরা তাদের চেয়েও কম সময় কারাগারে কাটিয়েছে।
ভয়ের আরও কারণ হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারগুলোর আচরণ আরও বেশি কঠোর হয়ে উঠছে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সমালোচকরা ঘরে এবং বাইরে ভীতি ও হামলার শিকার হচ্ছেন। সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকা খুবই সামান্য। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ৩৩ জন সাংবাদিক খুন হলেও কোনও হত্যাকাণ্ডের জন্য কারো শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতেও তদন্তে অবহেলার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
শুধু তাই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেই চান না। ফলে সরকারের সমালোচনার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকেরাও মামলা দায়ের অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার ঘটনায় তদন্ত চালানো সাংবাদিক রানা আইয়ুবের মুখমণ্ডল কেটে পর্নো ভিডিওতে জুড়ে দেওয়া হয়।
বাণিজ্যিক চাপও আছে। বন্ধু নয়, এমন সংবাদপত্রগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না। আর সেকারণে বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে নিতে চাপ দেওয়ার সুযোগ পায়।
এদিকে, কোভিড-১৯ মহামারি এশিয়ার সরকারগুলোকে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। রোগটি নিয়ে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগে ৫১ জনকে গ্রেফতার করেছে ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়াতেও মহামারি নিয়ে ফেক নিউজ ছড়ানোর অভিযোগে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে ২৯ ব্যক্তিকে। রোগ নিয়ন্ত্রণে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে জারি করা জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে।
এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মনোযোগ কাড়েনি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন মিলে বাখেলেট বলেছিলেন, বেশ কয়েকটি দেশ করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে ‘ভিন্নমত বা অবাধ তথ্য প্রবাহ ও বিতর্ক’ স্তব্ধ করছে। অনেক দেশই তার সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছে। ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ আটটি দেশ পাল্টা জানিয়েছে, ‘মহামারিতে অসাধারণ ও অভূতপূর্ব পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়’। সত্যি, সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত ভূমিকার ক্ষেত্রে এই তিন দেশ নিজেদের অসাধারণ ও অভূতপূর্ব হিসেবেই দেখতে পাবে। দুঃখজনক হলেও প্রত্যাশিত যে, সরকারগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো সংবাদমাধ্যম না থাকার ফলে মহামারি মোকাবিলা অনেক খারাপ হবে, অন্যথায় দেশগুলো আরও ভালো করতে পারত।