আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মুসলিমদের সম্পত্তি ও মসজিদে আক্রমণের ঘটনার পর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুসলিমদের আক্রান্ত স্থাপনা ও এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার এবং জনসমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়েছে।
গেল কয়েকদিন যাবত ত্রিপুরায় পুলিশের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষের পর সেখানে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। নৃশংস সেই ঘটনার জেরে ত্রিপুরায় বিক্ষোভ আয়োজনের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় সেখানকার হিন্দুরা প্রতিবাদ করছেন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গা পূজার বিশেষ মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননার গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের মন্দির, পূজা মণ্ডপ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়। এতে অন্তত সাতজনের প্রাণহানিও ঘটে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার তিন দিকেই বাংলাদেশের সীমান্ত এবং প্রতিবেশী রাজ্য আসামের সঙ্গেও তাদের একটি করিডর রয়েছে। ২৫ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর ২০১৮ সাল থেকে ত্রিপুরার ক্ষমতায় আছে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
গেল চার দিনে উত্তর ত্রিপুরা জেলার বিভিন্ন স্থানে ১০টির বেশি ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ত্রিপুরার সীমান্ত শহর পানিসাগরে একটি মসজিদ এবং মুসলিমদের বেশ কয়েকটি দোকানপাটে ভাঙচুরের ঘটনার পর থেকে সেখানে বড় ধরনের সমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ।
বিজেপির ঘনিষ্ঠ মিত্র ও দেশটির কট্টর হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে মুসলিমদের স্থাপনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। পানিসাগরের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা সৌভিক দেব বলেছেন, ওই সমাবেশে সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, সমাবেশে অংশগ্রহণ করা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছু কর্মী চামটিল্লার একটি মসজিদে ভাঙচুর করেছেন। পরবর্তীকালে সেখানে আরও তিনটি বাড়ি ও তিনটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। প্রথম ভাঙচুরের ঘটনা থেকে ৮০০ গজ দূরের রোয়া বাজার এলাকায় দুটি দোকানেও আগুন দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
প্রশাসনের দাবি, ভাঙচুর কৃত দোকান এবং বাড়িগুলো মুসলিমদের। তাদের একজনের অভিযোগের পর একটি মামলা দায়ের হয়েছে।
দেশটির আরেক কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বজরং দলের স্থানীয় নেতা নারায়ণ দাস অবশ্য জানিয়েছেন, মসজিদের সামনে কিছু তরুণ বিক্ষোভকারীদের গালাগালি এবং তরবারি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু দাসের এই অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ মিডিয়া বিবিসি বাংলা।
ত্রিপুরা পুলিশ টুইট বার্তায় বলেছে, কিছু সংখ্যক মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব এবং উসকানিমূলক বার্তা ছড়াচ্ছেন। আর শান্তি বজায় রাখতে এলাকার জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ।
গেল সপ্তাহে ভারতের মুসলিমদের সংগঠন জমিয়ত-উলামা-ই-হিন্দের ত্রিপুরা শাখা উত্তেজিত একদল জনতা মসজিদ ও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে। রাজ্য পুলিশ বলছে, তারা ত্রিপুরার দেড় শতাধিক মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
ভারতের এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ৪২ লাখ। এর মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যা প্রায় ৯ শতাংশ।
ত্রিপুরার লেখক বিকাশ চৌধুরী মনে করেন, ত্রিপুরার জনসংখ্যার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তু, তারপরও প্রতিবেশী দেশে এর আগে ধর্মীয় বিশৃঙ্খলার পর এখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
রাজ্যের বিরোধী দলগুলো মুসলিমদের ওপর হামলার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপির ঘনিষ্ঠ ‘রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোকে’ দায়ী করেছে।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সুস্মিতা দেব বিবিসি নিউজকে বলেছেন, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে রাজ্যের পৌরসভা নির্বাচনের আগে ভোটারদের ‘মেরুকরণ’ করতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে বিজেপি।
বিষয়টি জানতে ত্রিপুরার সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী রতনলাল নাথকে টেলিফোন করলেও কোনো সাড়া পায়নি বিবিসি বাংলা। গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় বিজেপির একজন নেতা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ব্রিটিশ মিডিয়াটিকে বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ভয়াবহ হামলার প্রতিক্রিয়ায় এখানে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা থেকে বিরোধীদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করা উচিৎ নয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা করা দরকার রাজ্য সরকার তার সবই করেছে বলে দাবি এই বিজেপি নেতার।
সাননিউজ/ জেআই