আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সাধারণতো বিভিন্ন জিনিস-পত্রের লোভনীয় অফার থাকলে মানুষ সেগুলো কিনতে ভিড় জমায়। কিন্তু পত্রিকা কিনতে মানুষের ভিড়! বিষয়টা আর্শ্চযজনক হলো সত্য। এবার হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি দৈনিক অ্যাপল ডেইলির সর্বশেষ সংস্করণ কিনতে শহরটিতে শত শত মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ই জুন) মধ্যরাত থেকে এমন ভিড় দেখা যায়। প্রকাশনার ২৬ বছরের মাথায় চীন নিয়ন্ত্রিত এই শহরের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের কঠোর ব্যবস্থার মুখে গণতন্ত্রকামীদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত পত্রিকাটির শেষ সংস্করণ ঘিরে আবেগতাড়িত হয়েছেন হংকংয়ের বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে; যারা পত্রিকাটি কিনতে সারিতে দাঁড়িয়েছেন। কারাগারে থাকা বেইজিংয়ের হংকং নীতির কট্টর সমালোচক জিমি লাইয়ের মালিকানাধীন অ্যাপল ডেইলি একটি ট্যাবলয়েড।
গণতন্ত্রপন্থিদের অধিকার-আন্দোলনে ন্যায্য সমর্থন, তারকাদের গল্প এবং ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ব্যাপক সমাদৃত ছিল এই দৈনিক। দুই যুগের বেশি সময় ধরে হংকংয়ের এই দৈনিক বেইজিংয়ের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
গত বছরের আগস্টে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় জিমি লাই গ্রেফতার হওয়ার পর অ্যাপল ডেইলি ঘিরে হংকংয়ের বাসিন্দাদের প্রচুর আবেগ দেখা যায়। সম্প্রতি এই পত্রিকাটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার পর সেটি বন্ধের ঘোষণা দেয় অ্যাপল ডেইলি কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ সংস্করণটি পেতে মধ্যরাত থেকেই হংকংয়ের রাস্তায় মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
মং কক জেলার একটি সংবাদপত্র বিতরণের দোকানের বাইরে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ানো সাবেক মেডিক্যাল কর্মী সে (৬০) বে, আমি গত কয়েক রাত ধরে ভালোভাবে ঘুমাতে পারছি না। আমি প্রত্যাশা করছি সাংবাদিকরা তাদের বিশ্বাসের প্রতি অটল থাকবেন এবং কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত রাখবেন।
শেষ সংস্করণের ঘোষণার পর পত্রিকাটির বার্তাকক্ষেও আবেগপ্রবণ হতে দেখা গেছে কর্মীদের। অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধনে পত্রিকাটি বলছে, ২৬ বছরের অপরিসীম ভালোবাসা এবং সমর্থনের জন্য সকল পাঠক, গ্রাহক, বিজ্ঞাপন দাতা এবং হংকংয়ের বাসিন্দাদের ধন্যবাদ।
এখানেই আমরা বিদায় জানালাম, নিজেদের যত্ন নিন।
তবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক কর্মী ক্ষোভ এবং হতাশাও প্রকাশ করেছেন। পত্রিকাটির ডিজাইনার ৫১ বছর বয়সী ডিকসন এনজি বলেন, আজকের পর থেকে হংকংয়ে গণমাধ্যমের কোনও স্বাধীনতা নেই... আমি হংকংয়ে কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, আমি আজ খুবই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। আমি বুঝতে পারছি না কেন এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কোম্পানি এবং পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হলো।
শেষ সংস্করণ ঘিরে হংকংয়ের বাসিন্দাদের চূড়ান্ত আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অ্যাপল ডেইলি কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার ১০ লাখ কপি ছেপেছে; যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের সমালোচকরা বলছেন, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ হংকংয়ের ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে আইনটি ব্যবহার করছে বেইজিং।
যদিও হংকং এবং বেইজিং কর্তৃপক্ষ সমালোচকদের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে হংকং এবং চীনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তা সীমাহীন নয়।
বহুল আলোচিত এই পত্রিকাটির একাধিক প্রতিবেদন সেখানকার জাতীয় নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করেছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করে হংকং কর্তৃপক্ষ। পরে গত সপ্তাহে অন্তত ৫০০ পুলিশ সদস্য অ্যাপল ডেইলির সদর দফতরে অভিযান চালিয়ে কম্পিউটার, প্রিন্টার ও অন্যান্য নথিপত্র জব্দ করে। একই সঙ্গে পত্রিকাটির পাঁচজন নির্বাহী কর্মকর্তা ও দুই প্রধান সম্পাদক রায়ান ল (৪৭) এবং চিয়াং কিম-হাংকে (৫৯) গ্রেফতার করা হয়।
বুধবারও পত্রিকাটির একজন নিবন্ধ লেখককেও জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে হংকং পুলিশ। কোম্পানির এক কোটি ৮০ লাখ হংকং ডলারের সম্পদ জব্দ করে কর্তৃপক্ষ।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, নাগরিক অধিকার এবং স্বাধীনতা জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করতে পারে না।
এদিকে, তাইওয়ানের চীনা নীতি-নির্ধারণবিষয়ক পরিষদ এক বিবৃতিতে অ্যাপল ডেইলির বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে রাজনৈতিক দমনের কারণে হংকংয়ের গণমাধ্যম তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।
বেইজিংয়ের এ ধরনের পদক্ষেপে তারা গভীর অনুশোচনা এবং তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছেন।
সূত্র: রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান।
সাননিউজ/এএসএম