আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ব্রাসেলসে ন্যাটো জোটের শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া এক বিবৃতির পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সাথে চীনের এক তীব্র সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিবৃতিতে চীনকে বড় সামরিক হুমকি হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি দেশটির আচরণকে ন্যাটো জোটের জন্য এক ‘ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ’ বলে বর্ণনা করেছে। ন্যাটো জোটের এই বিবৃতি চীনকে সাংঘাতিক ক্ষিপ্তও করেছে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় এ নিয়ে দীর্ঘ এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে ন্যাটোর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা হয়।
চীন বলছে, তাদের শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে 'মিথ্যে অপপ্রচার' চালানো হচ্ছে।
ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই সামরিক জোটের ইতিহাসে চীনের বিরুদ্ধে এতোটা কঠোর এবং বিরোধপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের নজির আর নেই।
নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে। এর লক্ষ্য ছিল মূলত ওই সময়ের অপর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করা। এরপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ন্যাটোর সব সামরিক কৌশলের কেন্দ্রে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যাতে করে ইউরোপে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ঠেকিয়ে দেয়া যায়।
ন্যাটোর সামরিক কৌশলে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়াকে এখনো মুখ্য হুমকি বলেই দেখা হয়। কিন্তু এই প্রথম সেখানে চীনকে বিরাট বড় এক হুমকি হিসেবে সামনে আনা হয়েছে। যদিও ইউরোপের কাছাকাছি কোথাও চীনের কোনো সামরিক উপস্থিতি এখনো নেই।
চীনকে নিয়ে কী বলেছে ন্যাটো জোট:
ব্রাসেলসের শীর্ষ সম্মেলন থেকে ন্যাটো জোটের পক্ষ থেকে যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয় তাতে চীনকে এক বড় সামরিক হুমকি হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, চীন তার পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা অনেক দ্রুতগতিতে বাড়াচ্ছে। চীন যেভাবে তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে, সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতাও শুরু করেছে।
ন্যাটোর বিচারে চীনের এসব আচরণ এখন তাদের জন্য এক 'সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ হুঁশিয়ারি দেন যে, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বিচারে চীন এখন ন্যাটোর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে তিনি আবার একথাও বলেছেন, চীনের সঙ্গে তারা একটা নতুন স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করতে চান না।
ব্রাসেলস সম্মেলন থেকে যে ইশতেহারটি প্রকাশ করা হয়, তা ৩০টি সদস্য দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। এটিতে রাশিয়াকেই এখনো প্রধান হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে চীনকে এতে দেখানো হয়েছে এক নতুন ‘ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে।
চীনকে নিয়ে এই উদ্বেগের ভিত্তি কী?
ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, সামরিক বাজেটের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন দ্বিতীয় স্থানে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী এখন চীনের। তারা তাদের পরমাণু অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে চলেছে। তারা আরো আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীন এখন বিশ্বের এক বড় সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি। চীনের সামরিক বাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে বড়। তাদের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা বিশ লাখের বেশি।
চীন তাদের অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য মহাদেশেও যেভাবে প্রভাব বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে আফ্রিকায়, সেটা নিয়েও পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বিগ্ন। সেখানে চীন কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছে।
ব্রাসেলস সম্মেলনে মিস্টার স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ‘চীন আমাদের শত্রু নয়, কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যাচ্ছে। চীন আমাদের অনেক কাছে চলে আসছে। চীনকে আমরা সাইবার-স্পেসে দেখতে পাচ্ছি, তাদেরকে আমরা আফ্রিকায় দেখতে পাচ্ছি, একই সাথে তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতেও বিনিয়োগ করছে। কাজেই ন্যাটোকে একটি জোট হিসেবে এসবের মোকাবেলা করতে হবে।’
চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে, তাদের জাহাজ আর্কটিক অঞ্চলের ভেতর দিয়েও গেছে। রাশিয়ার সাথে তারা যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে, যেটা বলতে গেলে একেবারে ন্যাটোর দোরগোড়ায়। ইউরোপে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর মালিক, এর মধ্যে গ্রীসের একটি বন্দরও রয়েছে।
চীনের যে বিনিয়োগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ সেটি হচ্ছে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক। চীনের হুয়াওয়ে পুরো আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ জুড়ে তাদের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি চালু করার চেষ্টা করছে। ন্যাটো এটা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত, এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে থাকলে, সেটার পরিণাম কী হতে পারে।
চীন যা বলেছে:
ন্যাটোর যৌথ ইশতেহারের পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনা মিশন থেকে টুইটারের একটি বিবৃতি দেয়া হয়। এতে চীন অভিযোগ করেছে যে ন্যাটো জোটের তরফ থেকে চীনে 'শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের' বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। চীন এমন এক প্রতিরক্ষা নীতিতে বিশ্বাসী যা 'আত্মরক্ষামূলক।'
এতে আরো বলা হয়, ‘চীন কারো জন্যই 'সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ' হতে চায় না, কিন্তু এরকম কোনো 'সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ' যখন আমাদের কাছে চলে আসবে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো না।’
চীন বলেছে, তারা যেভাবে তাদের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে, সেটা ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত। এটি তারা করছে স্বচ্ছতার সঙ্গে, খোলাখুলি।
চীনের উন্নয়নকে যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখার জন্য ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, এগুলো তাদের বৈধ স্বার্থ এবং অধিকার। ন্যাটোর উচিৎ নয় এগুলোকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সামরিক জোটের রাজনীতি হাসিল করা। কারণ এতে করে সংঘাত এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উস্কানি দেয়া হবে।
তবে চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় আজ যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়, সেটিতে আরো কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে ন্যাটোর বক্তব্যের। এটির শিরোনাম, ‘ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক স্বার্থে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।’
গ্লোবাল টাইমস চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পিপলস ডেইলি পত্রিকা গোষ্ঠীর একটি প্রকাশনা। এটির সম্পাদকীয়তে চীনা সরকারের মতামতই তুলে ধরা হয়।
এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন আসলে চীনের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ন্যাটোর মতো একটি সামরিক জোটকে ব্যবহার করছে। ন্যাটো সম্মেলন থেকে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলো মিথ্যাচার। ন্যাটোর বেশিরভাগ সদস্য দেশ আসলে চীনের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবেই মীমাংসা করতে চায়।
ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অঞ্চলে যদি কখনো যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তখন কী ঘটতে পারে, সেটার একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এই সম্পাদকীয়তে।
‘ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিকে ন্যাটোর সামরিক ক্ষমতা নিয়ে আসা ওয়াশিংটনের জন্য খুব কঠিন হবে। যখন ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিকে সামরিক সঙ্কট দেখা দেবে, যুক্তরাষ্ট্র তখন ন্যাটোকে ব্যবহার করবে যেন আরো বেশি পশ্চিমা দেশ চীনের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে, এবং চীনের উত্থান ধ্বংস করে দিতে পারে।’
‘চীনকে সামরিকভাবে জয় করার কোনো ইচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেই বলেই মনে করা হয়, কারণ চীন পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র আসলে চায়, চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বকে আরো তীব্র করার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য বাড়ানো, যাতে চীনকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে পিষে ফেলা যায়।
গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, চীন ইউরোপের জন্য কোনো হুমকি নয়, ইউরোপের সঙ্গে সহযোগিতা আরো বাড়াতে চীন অঙ্গীকারবদ্ধ। ওয়াশিংটনের 'আজ্ঞাবহ হয়ে' কেকের একটি ক্ষুদ্র অংশের ভাগ পাওয়ার চেয়ে বরং নিজের নিয়তি নিজে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এতে ইউরোপের প্রতি পরামর্শ দেয়া হয়।
ন্যাটোর ভেতরে টানাপোড়েন:
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে এই সামরিক জোটের উদ্দেশ্য এবং কৌশল কী হওয়া উচিৎ তা নিয়ে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে ন্যাটো জোট কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছিল মিস্টার ট্রাম্পের কারণেই। তিনি ইউরোপের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র কেন এত অর্থ খরচ করবে সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং ন্যাটোর বাজেটে ইউরোপীয় দেশগুলোকে আরো বেশি অর্থ দিতে হবে বলে দাবি করেছিলেন। এই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন নেটোর ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছিল।
তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ন্যাটোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'স্বার্থ রক্ষায়' ন্যাটো জোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ন্যাটো জোট এখন রাশিয়ার পাশাপাশি চীনকেও যে এক নতুন সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে, সেটা নিয়ে জোটের মধ্যে মতপার্থক্যের আভাস দেখতে পাচ্ছেন অনেকে।
এটি চীনের সঙ্গে এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে পারে, এমন আশঙ্কা করেন কেউ কেউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য জোট, আর চীনের সঙ্গে রয়েছে তাদের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ওয়াশিংটন চীনকে যেভাবে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখে, ইউরোপের অনেক দেশ সেভাবে দেখে না।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অবশ্য এরকম স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না, চীনের সঙ্গে একটি নতুন স্নায়ু যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন কেউ।’
একই ধরণের কথা শোনা গেছে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের মুখেও। ন্যাটো জোটের বৈঠক শেষে তিনি বলেছেন, ‘আপনি যদি সাইবার হুমকি বা হাইব্রিড হুমকির কথা ভাবেন, বা চীন-রাশিয়া সহযোগিতার দিকে তাকান, তাহলে চীনকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারবেন না।’
‘কিন্তু এটিকে খুব বেশি বাড়িয়ে দেখানো ঠিক হবে না। আমাদের একটি সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া দরকার। সূত্র: বিবিসি
সান নিউজ/এমএম