আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বসনিয়ার আট হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যার দায়ে সাবেক সার্ব কমান্ডার রাতকো স্লাদিচের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত সেই স্লাদিচ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় বহাল রেখেছে।
মঙ্গলবার (৮ জুন) বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পূর্বাঞ্চলীয় ছোট পার্বত্য শহর স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার দায়ে তার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন আদালত।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ম্লাদিচের বিচারের এ রায়ের মাধ্যমে বিশেষ এ ট্রাইব্যুনাল যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করল। এটিই ছিল ট্রাইব্যুনালের শেষ রায়।
১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের ওই ঘটনায় অন্তত ৮ হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল। ম্লাদিচ ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের অভিযোগ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ম্লাদিচ নেতৃত্বাধীন বাহিনীই স্রেব্রেনিৎসায় বসনীয় মুসলিমদের (বসনিয়াকস) নির্বিচারে হত্যা করে এবং সারায়েভোর দখল নেয়।
হেগের জাতিসংঘ ট্রাইবুনালে ম্লাদিচের বিরুদ্ধে মোট ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে ১০টিতে তাকে দোষীসাব্যস্ত করা হয়। যার মধ্যে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পাশাপাশি সারায়েভো অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অভিযোগও আছে।
তবে রায় ঘোষণার সময় ৭৪ বছরের ম্লাদিচ আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। বিচারকদের বিরুদ্ধে চিৎকার করার কারণে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
ম্লাদিচ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন জানিয়ে তার আইনজীবীরা বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার অনুরোধ করে। কিন্তু বিচারকরা সেই অনুরোধে সাড়া দেননি।
যদিও এদিন শুরুতে তাকে ভারমুক্ত ও হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। স্লদিচ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পোজও দিচ্ছিলেন।
ম্লাদিচ তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তার আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন।
আইনজীবীদের ভাষ্য, সার্ব বাহিনী ও তার মিত্রদের গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ ম্লাদিচের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মেলেনি। এজন্য অভিযুক্ত হলেও তাকে ১৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়ার সুযোগ নেই।
১৯৯১ সালে যুগোশ্লোভিয়া সো
শ্যালিস্ট ফেডারেশন ভেঙে পড়ার সময় ম্লাদিচ ছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। পরের বছর বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তার নির্দেশে সার্ব বাহিনী দেশটিকে দুই টুকরো ফেলে। তখন তিন বছর ধরে চলে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধ। এতে প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত হন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত রাতকো ম্লাদিচ ছিলেন তৎকালীন সার্ব সামরিক প্রধান।
১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে সেখানে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ওই ঘটনায় অন্তত আট হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সাড়ে চার বছরের বিচারকার্য চলার পর গত বছর ডিসেম্বরে আইনজীবীরা যুদ্ধাপরাধে তার যুক্ত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দাবি জানান।
পরে ওই মামলায় আদালতের দেয়া রায়ে ম্লাদিচকে ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা আখ্যা দেয়া হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী তখন তার নির্দেশেই সৈনিকরা ব্যাপক গণনিপীড়ন চালায়।
বসনিয়া যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ সার্বিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসায়কে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ডাচ সদস্যরা এলাকাটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই ম্লাদিচের বাহিনীর আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল ডাচ শান্তিরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করে।
সার্ব বাহিনী এরপর শহরটির পুরুষ ও বালকদের নারীদের কাছ থেকে আলাদা করে। পুরুষদের বাসে করে সরিয়ে নিয়ে কিংবা দূরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ব্রোঞ্জের বর্ম পরা ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসায়ের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ক্যামেরার সামনে তিনি শিশুদের মাঝে চকোলেট ও মিষ্টি বিলি করেন।
সান নিউজ/এমএইচ/এম