আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মেডিকেল অক্সিজেন ও শয্যার তীব্র সংকট চলার কারণে করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লির অনেক হাসপাতাল।
ফলে, বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন করোনায় গুরুতর অসুস্থ অনেক রোগী।
আর এই সংকটকে পুঁজি করে অক্সিজেন সিলিন্ডারের রমরমা ব্যবসা চলছে দিল্লি কালোবাজারে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
দিল্লির শহরতলী এলাকা নয়ডার বাসিন্দা অংশু প্রিয়ার শ্বশুর করোনায় আক্রান্ত। দিন দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। দিল্লি ও নয়ডার কোনো হাসপাতালে তিনি শ্বশুরকে ভর্তি করাতে পারেননি। হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
বিবিসিকে অংশু প্রিয়া জানান, সম্প্রতি তার শ্বশুরের শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হওয়ায় অক্সিজেন কিনতে গিয়ে বিশাল বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাকে। দিল্লির অনেক দোকানে ঘুরেও অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করতে পারেননি তিন।
শেষে বাধ্য হয়ে কালোবাজারে যোগাযোগ করেন অংশু প্রিয়া, এবং সেখান থেকে নগদ ৫০ হাজার রুপিতে কোনো রকমে একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার কিনতে সক্ষম হন। সাধারণ সময়ে এই সিলিন্ডারের বিক্রয়মূল্য সর্বোচ্চ ছয় হাজার রুপি।
বিবিসিকে অংশু প্রিয়া বলেন, ‘আমি এখন ভয় পাচ্ছি আমার শাশুড়িকে নিয়ে। তারও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে এবং আমার কাছে আর একটি সিলিন্ডার কেনার মতো টাকা আর অবশিষ্ট নেই।’
অংশু প্রিয়ার এই ঘটনা জানার পর বিষয়টি অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয় বিবিসি। কালোবাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং তাদের প্রত্যেকেই বিবিসিকে জানান, সংক্রমণের অতি উচ্চ হার এবং সেই অনুপাতে অক্সিজেনের সংকট চলায় দিল্লির কালোবাজারে ১০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার।
প্রাণঘাতী করোনার বিষাক্ত ছোবলে ভারতের যে কয়েকটি রাজ্য বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে, সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে আছে দিল্লি। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দিল্লিতে প্রতিদিন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। দিল্লির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, রাজ্যে প্রতিদিন করোনা টেস্ট করাতে আসা প্রতি তিনজনে একজন করোনা ‘পজিটিভ’ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন।
আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিল্লিতে বাড়ছে মৃত্যুসংখ্যাও। স্বাস্থ্য বিভাগসূত্রে জানা গেছে, রোববার করোনায় আক্রান্ত হয়ে দিল্লিতে মারা গেছেন ৩৫৭ জন।
এদিকে, মড়ার ওপর খাঁড়ার আঘাতের মতো এই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে দিল্লির চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা বর্তমান সংকট সামলাতে গিয়ে প্রায় ভেঙে পড়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেখানকার হাসপাতালগুলোতে চলমান শয্যা সংকটের পাশাপাশি এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে মেডিকেল অক্সিজেনের সংকট। সম্প্রতি দিল্লির একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন ২৫ চিকিৎসাধীন করোনা রোগী।
মেডিকেল অক্সিজেন ও শয্যার অভাবে অনেক হাসপাতাল নতুন রোগী ভর্তি করা বন্ধ করে দিয়েছে। বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একদিকে হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করা বন্ধ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে করোনা টেস্ট ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য টেস্ট করাতে গিয়ে রীতিমতো ভোগান্তিতে পড়েছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ।
দিল্লির একাধিক চিকিৎসক বিবিসিকে জানিয়েছেন, আরটি-পিসিআর টেস্টের রিপোর্ট পেতে যেখানে সর্বোচ্চ একদিন সময় লাগে, সেখানে বর্তমানে দিল্লিতে এই রিপোর্ট পেতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তিন দিন বা তারও বেশি। একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে সিটি স্ক্যান, এক্স রে ও করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য টেস্টের ক্ষেত্রেও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক বিবিসিকে বলেন, ‘ল্যাবগুলোকে অবশ্য খুব একটা দোষারোপ করা যায় না, কারণ বর্তমানে দিল্লিতে সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তাতে এখানকার ল্যাবগুলোকে তাদের ক্ষমতার ৪গুণ-৫ গুণ বেশি কাজ করতে হচ্ছে, এ কারণেই টেস্টের রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে।’
‘তবে সমস্যা হচ্ছে, করোনা হলে সবার আগে যেটি প্রয়োজন তা হলো দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা। টেস্টের রিপোর্ট আসতে দেরি হওয়ায় চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হচ্ছে, ফলে সংক্রমণও বাড়ছে। সামনে যে কী পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা কল্পনা করতেও ভয় হয়।’
করোনায় আক্রান্ত ভাইকে দিল্লির হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে বাড়িতে চিকিৎসা করাচ্ছেন দিল্লির অপর বাসিন্দা অনুজ তিওয়ারি। বিবিসিকে তিনি জানান, ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্য একজন নার্সকে নিয়োগ দিতে হয়েছে। পাশাপাশি অক্সিজেন ও ওষুধ কেনাবাবদ খরচ তো আছেই।
অনুজ তিওয়ারি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারিনি বলে বাড়িতে রেখে ভাইয়ের চিকিৎসা করাচ্ছি। কিন্তু কতদিন করাতে পারব জানি না, কারণ হাতের সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে। একসময় তা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে, তখন কী করব?’
সূত্র: বিবিসি
সাননিউজ/এএসএম