সান নিউজ ডেস্ক:
প্রায় এক দশক আগে ৮ এপ্রিল ৪০ বছর বয়সী বিধবা জরিনাকে বিয়ে করেছিলেন ৭৩ বছর বয়সী স্বামী আলী আহমেদ। চলতি বছর ছিল তাদের দশম বিবাহবার্ষিকী। তার একদিন আগেই ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মিরপুরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদকে। প্রকৃতপক্ষে খুনি আবদুল মাজেদ পরিচয় লুকিয়ে আলী আহমেদ নামে কলকাতায় বসবাস করছিলেন। ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে বাংলাদেশ সরকার।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আব্দুল মাজেদ আলী আহমেদ পরিচয়ে কলকাতায় বসবাস করছিলেন। সেখানে তিনি সুদের কারবার ও টিউশনি করিয়ে সংসার চালাতেন। সেখানে তার ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল। পার্কস্ট্রিট এলাকার বাসিন্দারা নম্র, ধার্মিক শিক্ষক হিসাবে জানতেন এবং আধার কার্ড সহ সম্পূর্ণ পরিচয় নিশ্চিত করেছিলেন।
এমনকি প্রায় এক দশক ধরে তার সাথে বিবাহিত জীবন কাটালেও জরিনা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি তার স্বামী আলী আহমেদ আসলে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনি আব্দুল মাজেদ। ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে জরিনা জানতে পারেন তার স্বামী মোস্ট-ওয়ান্টেড খুনি।
তিনি কলকাতায় নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি জরিনা স্বামীর খোঁজে স্থানীয় থানায় 'নিখোঁজ ডায়েরি’ করেছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারেন আলী আহমেদ আসলে বঙ্গবন্ধুর খুনি আব্দুল মাজেদ তখন হতবাক হয়ে যান। এখনো তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি,ঘন ঘন মূর্ছা যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।
আব্দুল মাজেদ সব সময় নীরব ও গম্ভীর থাকতেন জানিয়ে জরিনা বলেন, তিনি খুব গম্ভীর ও রাগী প্রকৃতির ছিলেন। অতীত নিয়ে কোন কথা বলতেন না। জানতে চাইলে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়তেন। সব সময় ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। খাবার দিতে কিংবা অন্য কোন বিষয়ে একটু দেরি হলেই গালিগালাজ করতে শুরু করতেন।
জরিনা বলছিলেন যে, তিনি যখন ৩১ বছর বয়সে আলী আহমেদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৬৪ বছর। কলকাতা থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে উলুবেড়িয়ায় গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের বিধবা নিরক্ষর মহিলা জরিনা। সেখানে তার আগের সংসারের এক কন্যা নিয়ে বসবাস করতেন।
এক প্রতিবেশী আলীর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবটি নিয়ে এসেছিল পরিবারের কাছে। এবং তারা আলীর অতীত বা পারিবারিক ইতিহাস না জেনেই জরিনার বিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আলী সর্বদা একজন অন্তর্মুখী মানুষ এবং কখনও বেশি কিছু বলেননি। আমি তাকে তার গ্রাম এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে অনেকবার জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছি, তবে তিনি রাগ করতেন।
প্রতিবেশীর প্রস্তাব আসায় আমার বাবা-মা আমাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। আমাদের জানানো হয়েছিল যে তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি এবং শিক্ষক ছিলেন। আমি তাকে সর্বদা পাঁচবার নামাজ পড়তে দেখেছি এবং একজন ধার্মিক মুসলমানের জীবনযাপন করতে দেখেছি।
জরিনার ভাই নাজিমুদ্দিন মল্লিক বলেছেন, তিনি এখন একটি গুরুতর স্নায়ুজনিত রোগে ভুগছেন। তিনি অন্যের করুণা নিয়ে বেঁচে আছেন। আমরা গরিব এবং কন্যাকে বিয়ে করান পরিবারের দায়িত্ব। জরিনার প্রথম স্বামী একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন এবং একা সন্তান নিয়ে জীবন যাপন করা অনেক কষ্টের হয়ে পড়েছিল। বছর দুয়েকের মধ্যে এই দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব এল। আমরা তার বিশদটি জানার চেষ্টা করেছি, তবে আমাদের জানানো হয়েছিল যে তিনি একজন শিক্ষক এবং আমাদের বোন ও তার সন্তানকে সুখী রাখতে তিনি ভাল উপার্জন করেছেন। আমরা কেবল তার ৮ এপ্রিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে তার পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ ভারতের কলকাতায় দীর্ঘ দিন আলী আহমেদ পরিচয়ে লুকিয়ে ছিলেন। খুনি মাজেদ কলকাতায় বসে সুদের ব্যবসা করতেন। এছাড়া টিউশনি করিয়েও সংসার চালাতেন। সেখানে তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল। তাঁর চেয়ে বয়সে ৩২ বছরের ছোট স্থানীয় এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন। সেই স্ত্রীর ঘরে তাঁর ছয় বছর বয়সী এক কন্যাসন্তানও আছে।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এমনিতে সুদের কারবার ও টিউশনির টাকায় সংসার চললেও সম্প্রতি তালতলা এলাকায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট বুক করেছিলেন মাজেদ। গোয়েন্দারা মনে করছেন, সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে টাকা আসত মাজেদের কাছে। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটে আর পা দেওয়া হল না তাঁর। তার আগেই ফাঁসিকাঠে নিথর হলেন তিনি।
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের ভাড়া বাড়িতে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদে। এলাকায় তাকে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেনি কেউ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন নিয়ম করে। সেই তাদের প্রিয় 'মাস্টারমশাই' নাকি বঙ্গবন্ধুর খুনি! এখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না লকডাউনের পার্ক স্ট্রিট।
সূত্র- দ্য প্রিন্ট।