আন্তর্জাতিক ডেস্ক : জাপানে ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ইয়েন। ২০১১ সালের ১১ মার্চ শুক্রবার সকালে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পের আঘাতে জাপানের পূর্ব উপকূলের ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তছনছ হয়ে যায় ।
৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের আঘাতে সুনামি তৈরি হয়, তাতে কার্যত ভেসে যায় হংসু দ্বীপ এবং মারা যায় প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। বড় ধরনের ঢেউ আঘাত হানে ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং এর পারমাণবিক চুল্লি প্লাবিত হয়ে পড়ে পানিতে, যা বড় ধরনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটায়।
কর্তৃপক্ষ একটি এক্সক্লুসিভ জোন তৈরি করে যা দিন দিন বড় হতে থাকে, কারণ কেন্দ্রটি থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছিল। ফলে আশপাশের এলাকা থেকে দ্রুত প্রায় দেড় লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই ঘটনার এক দশক পরেও এক্সক্লুসিভ জোনটি যেমন ছিল তেমনই আছে এবং সেখানকার বেশির ভাগ অধিবাসী আর ফিরে আসেনি।
কর্তৃপক্ষের ধারণা, সেখানকার কাজ শেষ করতে অন্তত চল্লিশ বছর সময় লাগবে এবং এর জন্য জাপানের ইতিমধ্যেই ব্যয় হয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ইয়েন। দশ বছর পরেও জাপানের উত্তর পূর্বাঞ্চলের অনেকগুলো শহর কার্যত বন্ধ আছে এবং কর্তৃপক্ষ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে যাতে অধিবাসীরা ফিরে আসতে পারেন।
বলা হচ্ছে, হাজার হাজার শ্রমিক প্রয়োজন হবে আগামী ৩০/৪০ বছরে নিরাপদে বিভিন্ন ধরনের পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য। এর মধ্যে রেডিয়েশনের ভয়ে কিছু অধিবাসী সেখানে আর কখনোই না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাপানের ফুকুশিমার ওকুমা শহরে যা দেশটির পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় তবে রাজধানী টোকিও থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে। আঘাত হানার মূল জায়গাটি ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মাত্র ৯৭ কিলোমিটার দুরে সেন্দাই শহরে।
সুনামি উপকূলে আঘাত হানার আগে সতর্ক হওয়ার জন্য মাত্র ১০ মিনিট সময় পেয়েছিল সেখানকার অধিবাসীরা। ভূমিকম্প, সুনামি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার কারণে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে।
ফুকুশিমার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সিস্টেম থেকে ভূমিকম্প চিহ্নিত হয়েছিল এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ হয়েছিল। তবে কুলিং সিস্টেম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি ডিজেল জেনারেটরগুলো চালু হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় ১৪ মিটার বা ৪৬ ফুট উঁচু ঢেউ ফুকুশিমায় আঘাত হানার পর পুরো কেন্দ্র পানিতে সয়লাব হয়ে যায় এবং জরুরি জেনারেটরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।
কর্মীরা বিদ্যুৎ পুনরায় চালুর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু এর মধ্যেই রিয়েক্টরের মধ্যে পারমাণবিক ফুয়েল প্রচণ্ড গরম হয়ে যায় এবং কোরের একটি অংশ গলে পড়ে। এরপর সেই কেন্দ্রে কয়েকটি রাসায়নিক বিস্ফোরণ হয় যাতে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেডিও এক্টিভ উপকরণগুলো লিক হয়ে বেরিয়ে এসে পরিবেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এ কারণেই দ্রুত লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয় এবং এক্সক্লুসিভ জোন তৈরি করা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ মারা যায়নি তবে বিস্ফোরণে কেন্দ্রটির ১৬জন কর্মী আহত হয়েছিল। আর রিয়েক্টর নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে রেডিয়েশনে আক্রান্ত হন।
জাপানের ভেতর ও বাইরের বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন রেডিয়েশনের ঝুঁকি ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন এর বিপদ ছিল অনেক বেশি। ২০১৮ সালে জাপান সরকার ঘোষণা দেয় যে রেডিয়েশনের কারণে একজন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তবে স্থানীয় হাসপাতাল ও বাড়িঘর থেকে লোকজনকে জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেওয়ার সময় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এই দুর্ঘটনাকে ৭ মাত্রার দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা এ ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। রাশিয়ার চেরনোবিল এর দ্বিতীয় উদাহরণ। সমালোচকেরা টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার বা সরকারের সমালোচনা করে আসছে, কারণ তারা মনে করেন সে সময় দুর্ঘটনা মোকাবিলার যথাযথ প্রস্তুতি ছিল না।
জাপান পার্লামেন্টের একটি স্বাধীন তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় যে,‘এটি মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ঘটনা এবং এনার্জি কোম্পানিকে দায়ী করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করার জন্য। তবে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ারের কর্মকর্তারা পরে আদালত থেকে রেহাই পান।
২০১৯ সালে একটি আদালত সরকারকে আংশিক দায়ী বলে আদেশ দিয়ে লোকজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
সান নিউজ/এসএ