ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
পুরো বিশ্বকে ওলট-পালট করে দিয়েছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। এরই মধ্যে ১৯৮টি দেশ এবং অঞ্চলে হানা দিয়েছে শক্তিশালী এই ভাইরাস। মৃত্যুতে এক দেশ আরেক দেশকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেনের মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলো। পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ঘর বন্দী। করোনার দ্রুত সংক্রমণ রোধে একে একে লকডাউন দেশের পর দেশ। এক দেশ বিচ্ছিন্ন আরেক দেশ থেকে। বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড পড়েছে ভেঙে। ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবার এক শতাংশেরও নিচে নেমে আসার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। আক্রান্ত অধিকাংশ দেশ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় পৃথক বরাদ্দ রাখছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু এসবের একেবারে উল্টো পথে হাঁটছে বেশ কয়েকটি দেশ বা রাষ্ট্রপ্রধান। তারা নিজ নিজ দেশের জনগণের সামনে ক্রমাগত ছোট করে তুলে ধরছেন করোনার ভয়াবহতাকে। কোন প্রকার আমলেই যেন নিচ্ছেন না করোনার তাণ্ডবকে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো করোনাকে আখ্যা দিয়েছেন 'সামান্য একটা ফ্লু' হিসেবে। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদর মানুষকে আহবান জানাচ্ছেন সপরিবারে বাইরে খাওয়া দাওয়া করতে। দেশটির নেতারা পারলে তুড়ি মেয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন করোনার আতঙ্ককে। আর নিকারাগুয়ার নেতা ড্যানিয়েল ওরতেগাতো কিছু বলছেনই না। বরং তাঁকে খুঁজেই যেন পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।
ব্রাজিলে এরই মধ্যে করোনাতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আক্রান্ত এবং ৬০ জনের মৃত্যু হলেও দেশটির প্রেসিডেন্ট বলছেন, করোনাভাইরাসকে নিয়ে শুধু আতঙ্কই ছড়ানো হচ্ছে। এর জন্য তিনি গণমাধ্যমকেও দায়ী করছেন খানিকটা। যদিও দেশটির সাও পাওলো ও রিও ডি জানেইরোর দুই গভর্নর নিজ নিজ রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
বলসোনারোর মতে, এই নভেল করোনাভাইরাসকে আসলে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। বলসোনারোর প্রেস সচিবও কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলেও গত রবিবার (২২ মার্চ) টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বললেন, “ এটি একটি সামান্য ফ্লু। জনগণ খুব শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে যে করোনাভাইরাসের কথা বলে তাদেরকে বোকা বানাচ্ছে কিছু গভর্নর এবং গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ।"
তবে করোনার মোকাবেলায় কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গৃহীত না হলেও, ব্রাজিলের স্থানীয় প্রশাসন ঠিকই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে। ফুটবল স্টেডিয়াম ও কনভেনশন সেন্টারগুলোকে তারা এরই মধ্যে সাময়িক হাসপাতালে রূপ দিয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে সব ধরণের জনসমাগম, বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শপিং মল।
এদিকে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরকে প্রথম যখন জানানো হল যে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাময়িকভাবে পারস্পরিক শারীরিক সংযোগ থেকে বিরত থাকতে হবে, তখন তিনি করলেন তার তীব্র প্রতিবাদ।
গণমাধ্যম কর্মীদেরকে তিনি বলেন, "তোমারা যদি পরস্পরকে আলিঙ্গন করো, তবে কিছুই হবে না এতে। একটি জিনিসকেই কেবল 'আলিঙ্গন' করা যাবে না। সেটি হলো করোনাভাইরাস নিয়ে কোন ধরণের ভয়ভীতি!”
পরে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক বিশ্বব্যাপী যখন ক্রমান্বয়ে আরও অনেক গুণ বেড়ে গেল, তখনও তিনি একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে সবাইকে নতুন করে চমকে দেন।
সেই ভিডিওতে দেখা গেল, অসংখ্য সমর্থক ঘিরে রেখেছেন ওব্রাদরকে। সেখানে অনেকের সঙ্গে আলিঙ্গন করার পাশাপাশি কোন কোন শিশুকে চুমু খেতেও দেখা যায় তাঁকে।
তবে মেক্সিকোতে আক্রান্তের সংখ্যা যখন ৪শ' ছাড়ালো আর মৃত্যুর সংখ্যাও ঠেকল ৬-এ এসে, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট সবার প্রতি আহ্বান জানালেন সবাইকে ঘরে থাকতে।
তবে সেই মুহূর্তে এসেও ওব্রাদর আবারও তাঁর একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে হকচকিয়ে দিলেন সবাইকে। তাতে তিনি বলেন, "আমরা কোনটাতেই ভাল কিছু করছি না। আমরা এভাবে যদি স্থবির হয়ে পড়ি, তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাবো অর্থনৈতিকভাবে। তাই চলুন আমরা সাধারণ জীবনযাপন অব্যাহত রাখি।"
দেশটিতে ভয়ানক ভাইরাসটিতে প্রায় অর্ধশত মানুষের আক্রান্ত হলেও করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সেখানকার বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, করোনাতে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্রাজিলের মতোই মেক্সিকোতেও কেন্দ্রীয়ভাবে কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলেও দেশটির স্থানীয় প্রশাসন এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন অনেক ধরণের দায়িত্ব। একসাথে ৫০-এর বেশি মানুষের জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা, সব ধরণের বার, নাইট ক্লাব এবং মুভি থিয়েটার বন্ধ রাখার মতো কাজগুলো শুরু করেছে তারাই। তবে কেন্দ্রীয় কড়া নজরদারি না থাকায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন সী-বিচ ও রেস্তোরাঁর মতো বিভিন্ন স্পটে।
ওদিকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ নিকারাগুয়ার অবস্থা একই রকম। একে তো দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা খুবই নাজুক, তার উপর আবার করোনাভাইরাসকে আমলে নিচ্ছে না সরকার। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা করোনাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে দেশটিতে। যদিও এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ২ জন। কিন্তু বাস্তবিক সংখ্যাটি আরো বেশি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের মনেই।
সঙ্গত কারণে তাই জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে সরকারিভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়। প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওরতেগা যে কোথায় আছেন, সেটিও ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ।কারণ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ওরতেগা নিজে জনসম্মুখে আসছেন না, যে কোন বিষয়ে সামনে রাখছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট রোজারিও মুরিলোকে। কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ভাইস প্রেসিডেন্টও জনগণকে কেবল উপদেশ দিচ্ছেন, বিপদের সময় 'ধর্মের কাছে সাহায্য প্রার্থনার'।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা ডিজিটাল ১৯-এ তিনি নির্লজ্জের মতো জানালেন কেবল সাধারণ মানুষের দায়িত্বের কথা। বললেন, “পাশের দেশ কোস্টারিকায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবরের পর থেকে আমাদের অনেক মানুষই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থাকতে শুরু করেছেন। সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসই পারে আমাদেরকে রক্ষা করতে ও বাঁচাতে।"
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশটির সরকার এখন পর্যন্ত দুইটি কাজই কেবল করেছে। জনসাধারণের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য প্রচারণা চালাতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য কর্মীদেরকে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করতে। আর নজরদারি রাখছে বিদেশী পর্যটকদের উপর।
নিকারাগুয়ার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে এই বৈশ্বিক মহামারী রোধে আগাম কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি, তাই পুরোপুরি দায়ী থাকবে তারাই।