আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রায় তিন মাস ধরে বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন ভারতের কৃষক সমাজ। পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। কৃষকরা এক সপ্তাহ আগে এসে পৌঁছায় রাজধানী দিল্লিতে। দিল্লি-পাঞ্জাব এবং দিল্লি-হরিয়ানা সীমানাতেও অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার কৃষক। উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ থেকেও দলে দলে কৃষক এসে তাতে যোগ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) মোদি সরকারের গৃহিত নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ভারতজুড়ে হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সাধারণ মানুষের সমস্যা তৈরি না করেই এ কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় কিষান সংগঠন। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত হরতাল চলবে।
বিজেপি-বিরোধী দলগুলো ইতিমধ্যেই কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু হরতাল চলাকালীন কোনও রাজনৈতিক দলকেই মঞ্চে ওঠার অনুমতি দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে কৃষকেরা।
বিক্ষোভ ঠেকাতে লাঠিপেটা থেকে শুরু করে জলকামান, কোনও কিছুই বাদ রাখেনি পুলিশ। দিল্লির ঠান্ডার মধ্যেও সে সব হজম করেছেন কৃষকেরা। পুলিশের মোকাবিলা করতে গিয়ে কখনও আন্দোলন হিংসাত্মক আকার ধারণ করেনি। তাই হরতাল ঘিরে যাতে কোনও রকম সহিংসতা দানা না বাঁধে, সে ব্যাপারে সচেতন তারা।
সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে সংসদে বিতর্কিত কৃষি বিল পাশ করিয়ে নেয় মোদী সরকার। তার পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলে তা আইনে পরিণত হয়। কিন্তু নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতায় গোটা দেশে অচলাবস্থা তৈরি হবে, তা বোধ হয় আঁচ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। তাই তিন মাস আগে পাঞ্জাবে আন্দোলন মাথাচাড়া দিলেও শুরুতে আমল দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। কিন্তু সেখান থেকে এই আগুন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে।
মূলত তিনটি আইন নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন কৃষকেরা। প্রথমত, সংশোধিত অত্যাবশ্যক পণ্য আইন। এর আওতায় আলু, পেঁয়াজ, ডাল, দানাশস্য, তৈলবীজ প্রভৃতিকে অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একমাত্র যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি দেখা না দিলে বড় বড় করপোরেট সংস্থাগুলো সেসব পণ্য যত খুশি মজুত রাখতে পারে।
এখানেই আপত্তি কৃষকদের। তাদের আশঙ্কা, এই আইনকে কাজে লাগিয়ে ফুলেফেঁপে উঠবে আম্বানি-আদানির মতো সুবিধাভোগীরা। কারণ ফসল ওঠার সময় দেশের অধিকাংশ ছোট চাষি কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ ফসল হিমঘরে মজুত করে রাখবেন বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা।
এর ফলে বাজারে অত্যাবশ্যক পণ্যের কৃত্রিম অভাব তৈরি হবে। তখন মাত্রাছাড়া দামে মজুত করে রাখা ফসল বাজারে ছাড়বে সেসব ব্যবসায়িরা। কৃষকদের ক্ষমতায়ন, ন্যায্য মূল্যের আশ্বাস এবং খামার পরিষেবা চুক্তির আইন, এই দ্বিতীয় আইনটি নিয়েও তীব্র আপত্তি কৃষকদের। এই আইনে বড় বড় সংস্থাগুলো চুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের যে কোনও ফসল উৎপাদন করাতে পারে বলে বলা রয়েছে।
তাতে চাষিরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন বলা থাকলেও, তা সুনিশ্চিত করার কোনও পদক্ষেপ নেই। ফসলের দাম নির্ধারণের কোনও উপায়ের কথাও উল্লেখ নেই তাতে। তৃতীয় আইনটি হলো, বাজার বা মাণ্ডির বাইরেও যে কোনও ব্যবসায়ী বা করপোরেট সংস্থার কাছে কৃষকদের ফল বিক্রি করার অধিকার। এত দিন ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা ছিল।
মাণ্ডি থেকে ফল কিনতে হলে তা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন আইনে সরাসরি কৃষক থেকে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ফসল কিনতে পারবেন বলা হয়েছে। কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা বলা নেই বলে দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা। তাদের আশঙ্কা, প্রথমে বেশই দাম হেঁকে তাদের প্রলোভিত করতে পারে বড় বড় সংস্থাগুলো।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বালাই না থাকায় ফসল কেনার ক্ষেত্রে সরকারও গড়িমসি করতে পারে। ঠিকমতো টাকা পাওয়া না গেলে মাণ্ডিতে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন কৃষকেরা। সে ক্ষেত্রে সমস্ত কৃষিপণ্যের একমাত্র ক্রেতা হবে বড় বড় সংস্থাগুলো। বাধ্য হয়ে তাই তাদের ঠিক করে দেওয়া দামেই ফসল বিক্রি করতে হবে কৃষকদের।
সরকারের তরফে এ সব নিয়ে মৌখিক আশ্বাস দেওয়া হলেও, আইন প্রত্যাহারের দাবিতেই অনড় কৃষকেরা। তা নিয়ে দফায় দফায় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে কৃষকদের প্রতিনিধি দলের। কিন্তু আইন সংশোধনে রাজি হলেও, তা প্রত্যাহারে সম্মত হয়নি সরকার। তাই নিজেদের দাবিতেই অনড় কৃষকেরা। এ ব্যাপারে সবার সমর্থন পেতেই ভারত হরতালের ডাক দিয়েছে তারা।
সান নিউজ/এসএ